সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মোহাম্মদ আসাদের শেষ সাক্ষাতকার

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করার জন্যে যে কয়েকজন বিদেশী বুদ্ধিজীবীর অবদান রয়েছে, আল্লামা মোহাম্মদ আসাদ তাঁদের অন্যতম। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন জার্মানের একটি ইহুদি পরিবারে, কিন্তু সত্যের সন্ধান করতে করতে পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

মোহাম্মদ আসাদ কেন এবং কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন, তা আলোচনা করার জন্যে তিনি একটি বই লিখেছিলেন - The Road to Mecca বা “মক্কার পথে”। বইটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক উস্তাদ শাহেদ আলী।

মোহাম্মদ আসাদ তাঁর জীবনের সর্বশেষ যে সাক্ষাতকারটি দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি “মক্কার পথে” বইটিকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে কয়েকটি পয়েন্ট এখানে উল্লেখ করছি।

১) ইসলাম গ্রহণ করার আগে মোহাম্মদ আসাদের আগে নাম ছিলো Leopold। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করার জন্যে জার্মানে বসবাসরত ভারতীয় মুসলিম আব্দুল জাব্বার খাইরির কাছে গিয়েছিলেন, তখন খাইরি তাকে বলেছিলেন – “জার্মান ভাষায় লেও (Leo) শব্দের অর্থ সিংহ, আর সিংহ শব্দের আরবি হলো “আসাদ”। তুমি তোমার নামটা পরিবর্তন করে মোহাম্মদ আসাদ রাখো”। সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেলো মোহাম্মদ আসাদ।

২) ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে মোহাম্মদ আসাদ ছিলেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক একজন সাংবাদিক। তাই তাকে সিরিয়া, ইরাক, ও আফগানিস্তান সহ বহু দেশে ভ্রমণ করতে হতো। এ কারণে তাকে আরবি ও ফার্সি ভাষাও শিখতে হয়েছে। তিনি সাধারণত রাস্তার মানুষদের কাছ থেকেই ভাষা শিখতেন।

একবার আফগানিস্তানের এক লোকের সাথে তিনি কথা বলছিলেন। আফগান লোকটি মুহাম্মদ আসাদকে বললেন – “তুমি কি মুসলিম?” আসাদ বললেন – “না”। তখন আফগান লোকটি বললেন – “You are Muslim, only you don't know it. One day you will came to know it” অর্থাৎ, “তুমি মুসলিম, কিন্তু তুমি তা জানো না। একদিন তুমি তা জানবে।”

এ কথাটি মোহাম্মদ আসাদের হৃদয়কে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিলো যে, তিনি এর কয়েক মাস পরেই মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন। আসাদের কাছে এ কথাটি নবীদের কথার মতো মনে হয়েছিলো।

[আমরা মুসলিমদেরকে কাফির ও মুনাফিক বলে তাকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেই, কিন্তু ঐ আফগান লোকটি একজন ইহুদি লেউপল্ডকেও মুহাম্মদ আসাদ বানিয়ে দিয়েছিলেন।]

৩) ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মোহাম্মদ আসাদ একদিন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে জার্মানের রাজধানী বার্লিন শহরে হাটছিলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর চতুর্দিকে সবাই দামী দামী পোশাক পরে চলছে, কিন্তু সবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাস করলেন, “সবার মুখ এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?” তাঁর স্ত্রী বললেন – “এরা সবাই অসুখী”।

কেন বার্লিন শহরের মানুষেরা সবাই অসুখী, তা অনুসন্ধান করতে লাগলেন মোহাম্মদ আসাদ। বাসায় এসে জার্মান ভাষায় কোর’আনের অনুবাদটা খুলে পড়তে লাগলেন। প্রথমেই যে সূরা তাঁর চোখে পড়লো, তা হলো সূরা তাকাছুর। এ সূরা পড়েই তিনি উত্তর পেয়ে গেলেন, কেন মানুষ অসুখী হয়।

এরপর আসাদ মনে মনে ভাবতে লাগলেন, ১৪০০ বছর আগের একটি গ্রন্থে বর্তমানের একটি সমস্যার সমাধান দিয়ে রাখা রাখা কিভাবে সম্ভব? নিশ্চয় এটি একটি ঐশী গ্রন্থ। তারপর, ঐদিন-ই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

৪) মোহাম্মদ আসাদ ৬ বছর সৌদি আরবে বসবাস করেন। সৌদি বাদশাহ আবদুল আজীজের আমন্ত্রণে তিনি তাঁর সাথেই ছিলেন এ ছয় বছর। একসাথে তাঁরা উভয়ে বিভিন্ন মরুভূমিতে ঘুরতেন।

বাদশাহ আবদুল আজিজ ওহাবী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি ছিলেন খুবই অমায়িক একজন মানুষ। উদাহরণ দিতে গিয়ে মোহাম্মদ আসাদ একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। একদিন মোহাম্মদ আসাদ ও বাদশাহ আবদুল আজিজ একটা গাড়িতে চড়ে মরুভূমিতে বের হলেন। পথে গাড়িটি বন্ধ হয়ে গেলো। ড্রাইভার গাড়ীর ইঞ্জিন দেখার জন্যে যখন একটু ঝুঁকলেন, তখন ড্রাইভারের পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বাদশাহর সামনে পড়ে গেলো। তখন সৌদি আরবে ধূমপান করা মারাত্মকভাবে নিষেধ ছিলো, তাই ড্রাইভার ভাবলেন, এবার হয়তো তার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। অথচ, বাদশাহ আবদুল আজিজ ড্রাইভারকে কিছু না বলেই অন্য দিকে তাকিয়ে মোহাম্মদ আসাদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। এরপর, ড্রাইভার আস্তে করে সিগারেটের প্যাকেটটা আবার পকেটে তুলে নিলেন।

৫) মোহাম্মদ আসাদ সাধারণ মুসলিমদের চেয়ে অনেক গভীরভাবে ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। এর ফলে ইসলামের সবকিছুকেই তিনি খুব যৌক্তিক ও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতেন। যেমন, কাবা শরীফের কালো পাথরটি চুমু দেয়াকে অনেকে মূর্তিপূজার সাথে তুলনা করেন। কিন্তু এর ব্যাখ্যায় মোহাম্মদ আসাদ বলেন, ইসলামের ইতিহাসে যত মুসলিম হজ্ব করেছেন, এবং কেয়ামত পর্যন্ত যত মুসলিম হজ্ব করবে, সবার প্রতি ভালোবাসা জানানোর জন্যেই কালো পাথরে চুমু দেয়া হয়।

মোহাম্মদ আসাদ কোর’আনের একটি ইংরেজি অনুবাদ করেন। এ ছাড়াও তিনি ইসলামের জন্যে অনেক অবদান রেখেছিলেন।

৬) বাংলাদেশ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করার জন্যে মোহাম্মদ আসাদকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ করেন মোহাম্মদ ইকবাল। ফলে জীবনের একটি লম্বা সময় মোহাম্মদ আসাদ বাংলাদেশ ও পাকিস্তান গঠন করার জন্যে কাজ করেছিলেন।

বিস্তারিত দেখুন এ ভিডিওতে, যা ছিলো তাঁর জীবনে শেষ সাক্ষাৎকার।

https://www.youtube.com/watch?v=OuoRAImuF1M

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্