সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব ও বিদ্রোহ করার শর্ত – ইমাম গাজালী

বর্তমান সময়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে শাসকের পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু, শাসক যখন গণতন্ত্রের বিপরীতে স্বৈরতন্ত্র বা রাজতন্ত্র কায়েম করে, এবং মানুষের উপর জুলুম করা শুরু করে, তখন বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়।

কোনো দেশে বিপ্লব করার জন্যে ইমাম গাজালী কিছু শর্ত দিয়েছেন। তিনি বলেন –

أنه لو تعذر وجود الورع والعلم فيمن يتصدى للإمامة وكان في صرفه إثارة فتنة لا تطاق حكمنا بانعقاد إمامته لأنا بين أن نحرك فتنة بالاستبدال فما يلقى المسلمون فيه من الضرر يزيد على ما يفوتهم من نقصان هذه الشروط التي أثبتت لمزية المصلحة فلا يهدم أصل المصلحة شغفاً بمزاياها كالذي يبني قصراً ويهدم مصراً وبين أن نحكم بخلو البلاد عن الإمام وبفساد الأقضية وذلك محال ونحن نقضي بنفوذ قضاء أهل البغي في بلادهم لمسيس حاجتهم فكيف لا نقضي بصحة الإمامة عند الحاجة والضرورة [إحياء علوم الدين 1/ 115]

“কোনো শাসকের মাঝে যদি খোদাভীরুতা ও ইসলামী জ্ঞান না থাকে, কিন্তু তাকে ক্ষমতাচ্যুত করলে যদি জনগণের অসহনীয় কষ্ট হয়, তাহলে আমাদের মতে, তাকে ক্ষমতায় বহাল রাখা উচিত। কারণ, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করলে দুটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। হয় অন্য লোক ক্ষমতায় আসবে, অথবা, শাসকের আসন খালি থাকবে। যদি নতুন কেউ ক্ষমতায় আসে তাহলে পুরাতন শাসকের ত্রুটির কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে, তার থেকে বেশি ক্ষতি হবে মুসলিমদের। এ শর্তটি জনগণের অধিক কল্যাণের জন্যেই আরোপ করা হলো। কারণ, ছোট উপকারের জন্যে বা (খোদাভীরু শাসকের জন্যে) জনগণের অধিক ক্ষতি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যেমন, একটি ঘর তৈরি করার জন্যে একটি শহর ধ্বংস করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অন্যদিকে, যদি কোনো দেশে শাসক না থাকে, তাহলে আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাই, জনগণের জরুরী প্রয়োজনে কোনো শাসকের খোদাভীরুতা না থাকলেও তাকে বহাল রাখা উচিত।” (ভাবানুবাদ) [১ম খণ্ড, ২৩৬]

ইমাম গাজালীর উপরোক্ত তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা আরো কিছু অনুসিদ্ধান্তে আসতে পারি –

১) ইমাম গাজালীর মতে, নেতা নির্বাচন ও মনোনয়নের জন্যে খোদাভীরুতা ও শিক্ষা একটি অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু খোদাভীরু ও জ্ঞানী শাসকের চেয়ে নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন শাসকের প্রয়োজন বেশি। কখনো কোনো শাসকের মধ্যে যদি খোদাভীরুতা কমে যায়, এবং সে যদি জনগণকে জুলুম করতে থাকে, তাহলে দেখতে হবে, তাকে সরিয়ে দিয়ে আরো ভালো কাউকে ক্ষমতায় আনা যায় কি না। যদি কোনো খারাপ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার কারণে দেশের অবস্থা আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়ে যাবার আশংকা থাকে, তাহলে তাকে ক্ষমতায় রাখাই ভালো।

২) ইমাম গাজালী কোনো স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় থাকার বৈধতা দেননি। কিন্তু তিনি চান, গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের নামে যাতে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি না হয়। যদি কেউ সত্যিই গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব করতে চায়, তাহলে তাদেরকে ক্ষমতাশীলদের চেয়ে বেশি সংগঠিত, কর্মদক্ষ ও জনগণের আস্তাভাজন হতে হবে।

৩) ইমাম গাজালীর এ তত্ত্বটির বাস্তব প্রমাণ পাই আমরা আরব বসন্তে। মিশর ও তিউনেশিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের ফল ভালো হলেও লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়ামেন সহ আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশে গণঅভ্যুত্থানের ফল ভালো হয়নি। মিশরে ব্রাদারহুড ও তিউনেশিয়ায় আন-নাহদার মতো দুটি সংগঠিত দল থাকার কারণে দুটি দেশে গণঅভ্যুত্থানের ফল ভালো হয়েছিলো। কিন্তু আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে ক্ষমতাশীলদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সংগঠিত কোনো দল না থাকার কারণে তাদের গণঅভ্যুত্থানে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে। কেবল সিরিয়াতেই সরকার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ফলে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে। এ ছাড়া আরব বসন্তে দেশগুলোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬৫০ বিলিয়ন ডলার।

সুতরাং, চাইলে যে কোনো দেশে বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান করে সরকারের পতন করা যায় না। বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের নামে অধিকাংশ সময় যে আন্দোলন করা হয়, তাতে দেশের জনগণের ক্ষতি আরো বাড়ে। তাই যে কোনো গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব করার পূর্বশর্ত হলো, আগে নিজেদেরকে সবদিক থেকে সরকারের চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত ও কর্মদক্ষ হিসাবে প্রস্তুত করা। তাহলেই কেবল বিপ্লব সফল হবে। অন্যথায়, বিপ্লবের নামে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...