সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইমাম আবু হানিফার হাদিস জানা সম্পর্কে ইবনে খালদুন

কেউ কেউ বলেন, ইমাম আবু হানিফা হাদিস জানতেন না, তাই তিনি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্যে যুক্তি বা অনুমানের উপর নির্ভর করেছেন।

ইবনে খালদুন উপরোক্ত কথাটা ভুল প্রমাণ করেন। যদিও ইবনে খালদুন মালেকি মাজহাবের একজন ফকিহ ও আলেম ছিলেন, তবুও তিনি ইমাম আবু হানিফার পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি তুলে ধরেন।

ইবনে খালদুন বলেন -

"গবেষক ইমামদের মধ্যে কেউ কেউ (তাঁদের গবেষণায়) বেশী সংখ্যক হাদিস ব্যবহার করেছেন, কেউ কেউ কম সংখ্যক হাদিস ব্যবহার করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) সম্পর্কে বলা হয় যে, (তাঁর গবেষণায়) ব্যবহৃত হাদিসের সংখ্যা প্রায় ১৭ টি। ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ)-র কাছে যে হাদিসগুলো সহীহ মনে হয়েছে, তিনি কেবল সে হাদিসগুলো তাঁর 'মুয়াত্তা' গ্রন্থে লিখেন; কিন্তু সেখানে হাদিসের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩০০ টি বা অনুরূপ কিছু। অন্যদিকে, আহমদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) তার 'মুসনাদ' গ্রন্থে প্রায় পাঁচ হাজার (৫০০০) হাদিসকে স্থান দিয়েছেন। প্রত্যেকেই তাঁদের গবেষণায় নিজেদের উল্লেখিত হাদিসগুলো ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন।"

কিছু হিংসুক ও হীনমনা ব্যক্তি বলেন যে, হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকার কারণেই তাঁরা কম সংখ্যক হাদিস ব্যবহার করেছেন। (অর্থাৎ, ইমাম আবু হানিফা তাঁর গবেষণায় মাত্র ১৭ টি হাদিস ব্যবহার করেছেন, কারণ, হাদিস সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফার তেমন কোনো জ্ঞান ছিলো না।) যারা এমন বলে, তাদের এসব কথা গল্প ছাড়া কিছুই নয়। কেননা, (ইমাম আবু হানিফা বা ইমাম মালেকের মতো) এমন বিশ্বস্ত ও বড় মানের ইমামগণ সম্পর্কে এসব ধারণা করা যায় না। তাঁদের প্রবর্তিত ধর্মীয় মতামতগুলো কোর'আন ও সুন্নাহর ভিত্তিতেই নেয়া হয়েছে।

যারা কম সংখ্যক হাদিস ব্যবহার করেছেন, তাঁরা কেন এমন করেছেন, তা অবশ্যই অনুসন্ধান করতে হবে, এবং এর কারণটা বুঝতে হবে।...

গবেষণায় কম সংখ্যক হাদিস ব্যবহারকারীগণ দেখেছেন যে, হাদিস ব্যবহার করতে গেলে বিভিন্ন বিতর্ক শুরু হয়। হাদিস বর্ণনাকারী অথবা হাদিসের সনদের বিভিন্ন ক্রুটি-বিচ্যুতির কারণে অনেকেই হাদিসের মূল বিষয়ে না গিয়ে সনদ নিয়ে বিতর্ক শুরু করেন। তাই গবেষণার উদ্দেশ্য ঠিক রাখার জন্যে তাঁরা হাদিসের সূক্ষ্ম বিতর্কগুলো এড়িয়ে গেছেন, এবং কম সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন। যেসব হাদিস তাঁদের কাছে একেবারেই সুস্পষ্ট মনে হয়েছে, তাঁরা কেবল সেসব হাদিস ব্যবহার করেছেন, এবং অন্য হাদিসগুলো তাঁরা বর্ণনা করেননি।

ইমাম আবু হানিফা কম সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করার কারণ হলো, তিনি হাদিস গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রচুর শর্তাদি মেনে চলতেন, এবং প্রচুর যাচাই-বাচাই করতেন। তিনি অনেক বিশ্বাস্যসূত্রের হাদিসকেও বাস্তবতা বিরোধী হওয়ার ফলে দুর্বল বলে ত্যাগ করেছেন। এ কারণে তাঁর (গবেষণায়) হাদিসের সংখ্যা কম ছিলো। وضعف رواية الحديث اليقيني إذا عارضها الفعل النفسي. وقلت من أجلها روايته فقل حديثه [مقدمة ابن خلدون ص: 255، بترقيم الشاملة آليا]

এটা মনে করার কারণ নেই যে, ইমাম আবু হানিফা ইচ্ছাকৃত হাদিস ত্যাগ করেছেন। তিনি হাদিস গবেষক শ্রেষ্ঠ ইমামদের অন্যতম ছিলেন। হাদিসশাস্ত্রবিদরাও তাঁর মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন, এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাঁর উপর নির্ভর করেছেন, এবং তাঁর নির্দেশনায় কিছু হাদিস গ্রহণ বা বর্জন করেছেন।

অবশ্য, ইমাম আবু হানিফা ছাড়া অন্য মুহাদ্দিসগণ হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে শর্তাদিকে আরো সহজ করেছেন। ফলে তাদের হাদিস বর্ণনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি ইমাম আবু হানিফার সহচর ও ছাত্ররাই তাঁর আরোপিত শর্তাদিতে প্রশস্ততা সৃষ্টি করেছেন। ফলে তাদের হাদিস বর্ণনাও অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিলো।"

সূত্র - মুকাদ্দিমা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা - ১২৫-৭ /مقدمة ابن خلدون ص: 255

এখানে সারমর্ম কথা হলো,

১) ইবনে খালদুন মালেকী মাজহাবের একজন আলেম হলেও ইমাম আবু হানিফাকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছেন।

২) হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যধিক শর্ত আরোপ করার কারণে তিনি মাত্র ১৭ টি হাদিসকে তাঁর গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি হাদিস জানতেন না। বরং তিনি নিজেই হাদিসের বড় ইমাম ছিলেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...