সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুতাজিলাদের উদ্ভব হবার কারণ

খ্রিস্টানরা যখন মুসলিমদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ করতে লাগলো, তখন কিছু মুসলিম খ্রিস্টানদের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণের জবাব দেয়া শুরু করলেন, যারা পরবর্তীতে মুতাযিলা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিতর্কটা কিছুটা এমন ছিলো -

খ্রিস্টান : "তোমরা মুসলিমরা ঈসা (আ)-কে আল্লাহ মানো না কেন?
মুসলিম : "কারণ, ঈসা (আ) জন্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা নিজেও জন্ম গ্রহণ করেন না, এবং কাউকে জন্ম দেন না।"
খ্রিস্টান : "আচ্ছা, তোমরা কোর'আনকে বিশ্বাস করো?"
মুসলিম : "অবশ্যই।"
খ্রিস্টান : "কেন বিশ্বাস করো?"
মুসলিম : "কারণ, কোর'আন আল্লাহ বানী (কালিমাতুল্লাহ)।"
খ্রিস্টান : "আচ্ছা, কোর'আন কি নশ্বর নাকি অবিনশ্বর?"
মুসলিম : "কোর'আন অবশ্যই অবিনশ্বর।"
খ্রিস্টান : "তাহলে তোমরা ঈসা (আ)-কে কেন অবিনশ্বর মনে করো না? তোমাদের কোর'আন অনুযায়ী তিনিও তো আল্লাহর বানী (কালিমাতুল্লাহ)। কোর'আনের মতো ঈসা (আ) তো অবিনশ্বর। সুতরাং, তোমরা তাকে প্রভু হিসাবে মেনে নাও।"

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মুসলিমরা সর্বপ্রথম একাডেমিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়।

মুসলিমদের এক পক্ষ বলেন, "ঈসা (আ) অবিনশ্বর নয়, এবং কোর'আনও অবিনশ্বর নয়। অর্থাৎ, কোর'আন ও ঈসা (আ) উভয়ে আল্লাহর সৃষ্টি।"

মুসলিমদের অন্য পক্ষ বলেন, "ঈসা (আ) আল্লাহর সৃষ্টি, কিন্তু কোর'আন আল্লাহর সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ, কোর'আনকে যদি আল্লাহর সৃষ্টি বলা হয়, তাহলে আল্লাহর অন্য সৃষ্টির মতো কোর'আনও এক সময়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু, আল্লাহ নিজেই তাঁর বানীকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিয়েছেন। সুতরাং, কোর'আন কখনো আল্লাহর সৃষ্টি হতে পারে না।"

এভাবে কিছুদিন মুসলিমদের দু'দলের মাঝে বিতর্ক চলতে থাকলো।

এরপর, ইমাম আবু হানিফা এসে বলেন, তোমরা দুই দল একটু চুপ করো। আমি কিছু কথা বলি। কোর'আনের দুটি অংশ রয়েছে। একটি অংশ হলো অবিনশ্বর, অন্য একটি অংশ হলো নশ্বর। কোর'আনের একটি অংশ হলো সৃষ্টি, এবং আরেকটি অংশ সৃষ্টি নয়। কোর'আনের যে অক্ষরগুলো আমরা দেখি, এবং কোর'আনের যে আওয়াজ আমরা শুনি, তা হলো সৃষ্টি। কিন্তু অক্ষরহীন ও উচ্চারণহীন যে কোর'আন লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত আছে, সেটা সৃষ্টি নয়।

একইভাবে, যে ঈসা (আ) মরিয়মের গর্ভে জন্ম নিয়েছেন, সে ঈসা আল্লাহর সৃষ্টি। কিন্তু, ঈসা (আ) -এর যে রূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, সে রূহ সৃষ্টি নয়।

ইমাম আবু হানিফা উপরোক্ত উত্তর দিয়ে মুসলিমদের দুই পক্ষের বিতর্ক অনেকটা মিটমাট করে দিয়েছেন।

কয়েকটি অনুসিদ্ধান্ত -

১) মুতাজিলাদের উদ্ভব হয়েছে খ্রিস্টানদের বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণের জবাব দেয়ার জন্যে।
২) ইমাম আবু হানিফার উদ্ভব হয়েছে মুতাজিলা ও অন্য মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ্বের সমাধান করার জন্যে।
৩) ইসলামের প্রতিটি গ্রুপের উদ্ভব হয়েছে ইসলামকে অন্যদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এবং কোনো না কোনো সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্য ।

সূত্র -

{ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ} [النساء: 171]

واالقرآن كَلَام الله تَعَالَى فِي الْمَصَاحِف مَكْتُوب وَفِي الْقُلُوب مَحْفُوظ وعَلى الألسن مقروء وعَلى النَّبِي عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام منزل ولفظنا بِالْقُرْآنِ مَخْلُوق وكتابتنا لَهُ مخلوقة وقراءتنا لَهُ مخلوقة وَالْقُرْآن غير مَخْلُوق
[الفقه الأكبر ص: 20]

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...