সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুদমুক্ত সুখী জীবন

অর্থনীতিতে একটি সূত্র আছে, “মানুষের চাহিদা অসীম, সম্পদ সীমিত”। এ সূত্রটিকে অর্থনীতিতে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হয়, কিন্তু ইসলামে নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হয়।

অর্থনীতিতে উপরোক্ত সূত্রকে ইতিবাচকভাবে দেখার অনেক কারণ আছে।

মানুষ কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। মানুষ কোনো জিনিস একটা পেলে দুইটা পেতে চায়, দুইটা পেলে তিনটা পেতে চায়। অর্থাৎ, স্বভাবগতভাবেই মানুষ চাহিদাকে সীমিত করতে পারে না। মানুষের এ অভ্যাসকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির উপরোক্ত সূত্রটি আবিষ্কার করা হয়েছে। ফলে, এ সূত্রটিকে অর্থনীতিতে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়।।

বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতি সম্পূর্ণটাই দাঁড়িয়ে আছে সুদের ভিত্তিতে। উপরোক্ত সূত্রের দ্বারা সুদের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ, যেহেতু আমাদের সম্পদ সীমিত, এবং যেহেতু আমাদের চাহিদা অসীম, তাই আমাদের চাহিদা পূরণ করার জন্যে সুদের বিনিময়ে আমাদের টাকা ঋণ নেয়া প্রয়োজন। এতে আমরা আমাদের সকল চাহিদা পূরণ করতে পারবো।

অন্যদিকে, ইসলাম উপরোক্ত সূত্রটিকে নেতিবাচকভাবে দেখারও অনেক কারণ আছে।

১) “মানুষের চাহিদা অসীম, কিন্তু সম্পদ সীমিত” – এ সূত্রের ঠিক বিপরীত সূত্র দেয়া হয়েছে আল কোর’আনে। আল্লাহ বলেন –

وَاٰتٰيكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَاَلْتُمُوهُۜ وَاِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللّٰهِ لَا تُحْصُوهَاۜ اِنَّ الْاِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ۟

“তোমরা যা চেয়েছো (তোমাদের যা চাহিদা), সবকিছুই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গণনা কর, তাহলে নিয়ামতের সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই অতিমাত্রায় জালিম, অকৃতজ্ঞ”। [সূরা ১৪/ইব্রাহীম – ৩৪]

উপরোক্ত আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝা যায় –

i) অর্থনীতিতে বলা হচ্ছে, “মানুষের চাহিদা অসীম, এবং সম্পদ সীমিত”। কিন্তু কোর’আনে বলা হচ্ছে, “মানুষের সম্পদ অসীম, কিন্তু চাহিদা সীমিত”। অর্থাৎ, ইসলামে সম্পদের ধারণার সাথে অর্থনীতির সম্পদের মিল নেই। একইভাবে ইসলামের চাহিদার ধারণার সাথে অর্থনীতির চাহিদার মিল নেই।

ii) পৃথিবীতে মানুষের যত চাহিদা আছে, আল্লাহ তায়ালা সব চাহিদা পূরণ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ, মানুষের অপূরণীয় কোনো চাহিদা নেই। অন্যদিকে, পৃথিবীতে মানুষের জন্যে সৃষ্ট আল্লাহর সম্পদের কোনো শেষ নেই। মানুষ সম্পদের হিসাব করেও শেষ করতে পারবে না। অর্থাৎ, সম্পদ অসীম।

iii) ইসলামে মানব জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছুকেই সম্পদ বা নিয়ামত মনে করা হয়। কিন্তু, অর্থনীতিতে কেবল এমন জিনিসকে সম্পদ মনে করা হয়, যা বিক্রয়যোগ্য। যেমন, সুস্বাদু-পরিচ্ছন্ন-স্বাস্থ্যকর বৃষ্টির পানিকে অর্থনীতিতে সম্পদ মনে করা হয় না, কিন্তু প্লাস্টিকের বোতলে ভর্তি বিভিন্ন কোম্পানির পানিকে সম্পদ মনে করা হয়।

iv) সুদের মাধ্যমে অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করাকে ইসলামে জুলুম বলা হয়, কিন্তু অর্থনীতিতে তাকে ব্যবসা মনে করা হয়। একইভাবে, অতিরিক্ত চাহিদার অধিকারী মানুষকে ইসলাম অকৃতজ্ঞ বলে ভৎসনা করে, কিন্তু আধুনিক অর্থনীতি মানুষকে অতিরিক্ত চাহিদার জন্যে উৎসাহ প্রদান করে।

২) অসীম চাহিদার মানুষদেরকে ভৎসনা করে কোর’আনে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন –

اَلْهٰيكُمُ التَّكَاثُرُۙ - حَتّٰى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَۜ

“প্রচুর সম্পদের চাহিদা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও”। [সূরা ১০২/তাকাছুর – ১,২]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন –

وَاِذْ تَاَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَاَز۪يدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ اِنَّ عَذَاب۪ي لَشَد۪يدٌ

“তোমাদের প্রতিপালকের ঘোষণা স্মরণ করো। তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের অবশ্যই বাড়িয়ে দিবো। আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর”। [সূরা ১৪/ইব্রাহীম - ৭]

উপরের দুটি আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি –

i) সম্পদের প্রতি মানুষের চাহিদা কখনোই শেষ হয় না। এমনকি কবর যাবার আগ পর্যন্ত মানুষের চাহিদা থাকে। কিন্তু, মানুষের এমন অসীম চাহিদা কোর’আনের দৃষ্টিতে খুবই খারাপ।

ii) মানুষ যদি তাদের চাহিদাকে সীমাবদ্ধ করতে পারে, এবং আল্লাহর দেয়া সম্পদের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারে, তাহলে আল্লাহ তার সম্পদ আরো বাড়িয়ে দিবেন। কিন্তু, কেউ যদি তার অসীম চাহিদার কারণে আল্লাহর দেয়া সম্পদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে না পারেন, তাহলে সে নিজেই অনেক অশান্তির মধ্যে থাকবে। এবং তার অশান্তিকে আল্লাহ আরো বাড়িয়ে দিবেন।

সমস্ত আলোচনার মূল কথা হলো, অতিরিক্ত চাহিদা মানুষকে সুদ দেয়া-নেয়ার প্রতি উৎসাহিত করে। একজন ব্যক্তির চাহিদা যদি কম থাকে, তাহলে তিনি ব্যাংক থেকে সুদের বিনিময়ে টাকা ঋণ নিবেন না, বরং জীবনে উপর ধৈর্য ধারণ করবেন। কিন্তু, যাদের চাহিদা বেশি, তারা জীবনের ওপর ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না, বরং ব্যাংক থেকে সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়ে নিজেদের চাহিদা পূরণ করবেন। এতে তাদের চাহিদা আরো বাড়তে থাকবে, এবং না পাবার হতাশাও আরো বাড়তে থাকবে। পরিশেষে তিনি একটি অশান্ত ও অসুখী জীবন নিয়েই মরতে হবে। তাই সুখী জীবনের জন্যে সুদমুক্ত থাকুন। এবং সুদমুক্ত থাকার জন্যে চাহিদাকে সীমাবদ্ধ করুন, এবং আপনাকে দেয়া আল্লাহর অসীম নেয়ামতকে অনুভব করুন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...