সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তু্রস্কে সেক্যুলারগণ কেন ক্ষমতায় আসছে?

বিদেশি প্রচার মাধ্যমগুলো অনেক দিন থেকে প্রচার করে আসছে, এরদোগান হলো স্বৈরাচার। এরদোগান ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে আছেন একমাত্র স্বৈরাচার হওয়ার কারণে। তুরস্কে কোনো গণতন্ত্র নেই। এতদিন যারা এসব বলে আসছিল, এবার তাদের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। কারণ ইস্তানবুলের নির্বাচনে পরপর দুইবার এরদোগানের দল হেরে যাওয়ায় এটা প্রমাণিত হয়েছে, তুরস্কের গণতন্ত্র অনেক বেশি শক্ত। ফলে ২০ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকার পরও ইস্তানবুলের নির্বাচনে এরদোগান ও তার দল স্বৈরাচারী কোনো আচরণ করেনি। বরং নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর এরদোগান ও তার দলের প্রার্থী বিন আলী ইলদ্রিম উভয়ে জয়ী প্রার্থী ইমামউগলুকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

এরদোগান বলেছেন, ‘এই নির্বাচনে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত ফলাফল লাভ না করার পেছনে একমাত্র কারণ হলো, দেশবাসীকে আমরা আমাদের কথা ভালোভাবে বোঝাতে পারিনি। দেশবাসীর হৃদয়ে আমরা ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারিনি বলে এমন ফলাফল হয়েছে বলে আমি মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেশের জনগণকে কখনও দোষ দেব না এবং দেশবাসীর মাঝে কোনো ত্রুটি খোঁজার চেষ্টাও করব না। বরং আমরা আমাদের নিজের দলের মধ্যে ত্রুটি খুঁজে বের করতে হবে এবং আজ থেকেই তা সংশোধনের জন্য কাজ শুরু করে দিতে হবে।’ এরদোগানের উপরোক্ত বক্তব্যে প্রমাণ হয়, তিনি জনগণকে নিয়েই রাজনীতি করতে চান এবং জনগণের সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে চান। তাই তিনি ও তার দল একে পার্টি সেক্যুলার দলের বিজয়ী প্রার্থী ইমামউগলুকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

যদিও ইস্তানবুলে এরদোগানের দল হেরে গেছে; কিন্তু তাতে এরদোগানের গুরুত্ব কোনো অংশেই কমে যায়নি। কারণ ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালের ২৪ জুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে এরদোগান ক্ষমতায় আসেন। সংবিধানের এমন পরিবর্তনের ফলে এরদোগান এখন তার দলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ইস্তানবুল বা আনকারায় দল হেরে গেলেও এরদোগানের গুরুত্ব ও গণতান্ত্রিক ক্ষমতা কোনো অংশে কমে যায়নি।

ইস্তানবুল ও আনকারায় এরদোগানের দল হেরে যাওয়ার মূল কারণ ডলার। স্থানীয় নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে থেকে এরদোগান ফিলিস্তিনের ইস্যুতে আমেরিকা ও ইসরাইলের ব্যাপক সমালোচনা করেন। এরপর থেকে এরদোগানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। ফলে ডলারের বিপরীতে তুরস্কের লিরার মান খুবই কমে যায়। দুই বছর আগে ১ ডলার ছিল ৩ তার্কিশ লিরা। কিন্তু গত দুই বছরে ১ ডলারের বিপরীতে তার্কিশ লিরা হয়েছে ৬ থেকে ৬.৫০ পর্যন্ত। অর্থাৎ দুই বছর আগে যারা ১০০ ডলারের মালিক ছিল, তারা গত দুই বছরে তাদের অর্ধেক সম্পদ হারিয়ে ফেলে ৫০ ডলারের মালিক হয়ে গেছে। এ কারণে এরদোগানের প্রতি ব্যবসায়ীদের প্রচুর ক্ষোভ জন্মে। ইস্তানবুল ও আনকারা যেহেতু ব্যবসার মূলকেন্দ্র; তাই এ দুই স্থানে এরদোগানের দল হেরে গেছে।

এরদোগান অবশ্য এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনের পর আমেরিকার সঙ্গে আবার সম্পর্ক ভালো করার এবং লিরার দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে ইস্তানবুলের বর্তমান মেয়র ইমামউগলু যদিও সেক্যুলার দল ঈঐচ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু ইমামউগলুর সঙ্গে সেক্যুলার দলের নেতাদের অনেক পার্থক্য রয়েছে। ইমামউগলু কট্টর সেক্যুলার নন, বরং তিনি নির্বাচনি অনেক বক্তব্যে ইসলামপন্থিদের মতো কথাবার্তা বলেছেন। সেক্যুলার দলের নেতারা যেখানে তাদের মতাদর্শিক কথাবার্তা বলেন, সেখানে ইমামউগলু আইয়ুব সুলতান মসজিদে গিয়ে সুন্দর কণ্ঠে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করেন। তিনি ইস্তানবুল নির্বাচনের আগে রাসুল (সা.) এর সাহাবি আইয়ুব আনসারি (রা.) এর কবর জিয়ারত করেন এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথম কার্যদিবস শুরু করেন। এভাবে তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের হৃদয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন। এমন কার্যক্রমের কারণে অসংখ্য ইসলামপন্থি সেক্যুলার ইমামউগলুকে ভোট দিয়েছেন। যেমন তুরস্কের ইসলামপন্থি সাদাত পার্টি এবং ফেতুল্লাহ গুলেনের ইসলামপন্থিরা সেক্যুলার দলের ইমামউগলুকে ভোট দিয়েছেন। ফলে এ নির্বাচনটা ইসলামপন্থি বনাম সেক্যুলারপন্থি এমন হয়নি।

ইস্তানবুলের বিজয়ী মেয়র ইমামউগলু সব ক্ষেত্রে আসলে এরদোগানকে অনুসরণ করেন। ইমামউগলু এরদোগানের মতো ইস্তানবুলের মেয়র থেকে রাষ্ট্রপতি হতে চান। এজন্য আপাতত মুসলিমদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কাজ করতে আগ্রহী নন তিনি। বরং তিনি এখন দেশের সব মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। এ কারণে মোটা দাগে বলা যায়, ইস্তানবুলে আসলে সেক্যুলাররা জয়ী হয়নি, বরং এরদোগানের বিপক্ষের সব ইসলামপন্থি, এরদোগানের দল থেকে বের হয়ে যাওয়া মানুষগুলো এবং সেক্যুলাররা মিলে এ নির্বাচনে এরদোগানের দলকে হারিয়ে দিয়েছেন। এখন এরদোগানের কথা অনুযায়ী তিনি যদি আসলেই নিজের দলের ভুলগুলো খুঁজে বের করতে পারেন এবং সেগুলো সংশোধন করতে পারেন, তাহলে তার দল থেকে বের হয়ে যাওয়া ইসলামপন্থিদের সমর্থন তিনি আবারও পাবেন। অথবা ইমামউগলু যদি ক্ষমতা গ্রহণের পর সেক্যুলার কথাবার্তা বলা শুরু করেন, তাহলেও এরদোগানের দলের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে।

 

http://www.alokitobangladesh.com/online/details/71161

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...