সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলা ভাষায় পাঠ্যবই না হবার সমস্যা ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা

আমাদের দেশের মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন চিন্তা উদ্ভাবন হয় না। এর কারণ কি?

যে কোনো বইয়ের লেখক এক বা একাধিক প্রশ্ন ও সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্যে বই লিখেন। ধরুন, মানুষের দুঃখের সময়ে তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যেই হুমায়ুন আহমেদ উপন্যাস লিখতেন। এ বইতে সমস্যা কি আর সমাধান কি? তা বুঝা প্রয়োজন। এখানে সমস্যা হলো - মানুষের দুঃখ, আর সমাধান হলো - আনন্দ। যদি হুমায়ুন আহমদের উপন্যাস পড়ে আনন্দ মানুষ পায়, তাহলে তার উপন্যাস লেখা সার্থক। এবং পাঠক হিসাবে কেউ যদি হুমায়ুন আহমদের উপন্যাস পড়ে আনন্দ পায়, তাহলে পাঠক হিসাবে তিনি সার্থক। কিন্তু, কেউ যদি হুমায়ুন আহমদের উপন্যাস পড়ে আনন্দ না পায়, তাহলে তার জন্যে হুমায়ুন আহমদের উপন্যাস পড়া মানে সময়ের অপচয়।

ঠিক একইভাবে, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বইগুলো পড়ানো হয়, সে বইগুলো কিছু সমস্যার সমাধান করার জন্যে লিখা হয়েছে। ধরুন, ইমাম আবু হানিফার 'ফিকহুল আকবর' বইটি কিছু সমস্যার সমাধান করার জন্যে লিখা হয়েছে। কেউ যদি 'ফিকহুল আকবর' পড়ে ঐ সমস্যাগুলো ধরতে পারেন, এবং এর সমাধানগুলো বুঝতে পারেন, তাহলে পাঠক হিসাবে তিনি সার্থক হবেন। কিন্তু, আরবি ভাষায় লিখিত ফিকহুল আকবর বইয়ের কেবল বাংলা অর্থ করতে পারলেই পাঠক হিসাবে তিনি সার্থক নন। অন্যদিকে, কেউ যদি বাংলা ভাষায় ফিকহুল আকবর পড়ে, আবু হানিফার দেয়া সমস্যা ও সমাধানগুলো বুঝতে পারেন, তাহলে তিনি আরবি জানা পাঠকের তুলনায় বেশি সার্থক হবেন।

অর্থাৎ, ইমাম আবু হানিফা তাঁর ফিকহুল আকবর রচনা করার সময়ে এটা ভেবে রচনা করেননি যে, এই বই পড়ে মানুষ তার আরবি ভাষার জ্ঞান উন্নত করবে। ইমাম আবু হানিফা কিছু সমস্যার সমাধান করার জন্যেই ফিকহুল আকবর লিখেছেন। কেউ যদি আরবি বা বাংলায় পড়ে এই বইতে দেয়া সমস্যা ও সমাধানগুলো বুঝতে পারেন, তাহলে পাঠক হিসাবে তিনি সার্থক হবেন। পাঠক তখন ইমাম আবু হানিফার মতো চিন্তা করতে শিখবেন, এবং নতুন চিন্তার উদ্ভাবন করতে পারবেন।

আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে চিন্তা করা শেখানোর জন্যে বই পড়ানো হয় না, বরং বই পড়ানো হয় আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার জন্যে। ধরুন, কেউ বললেন যে, আমি অমুক মাদ্রাসায় ইমাম আবু হানিফার ফিকহুল আকবর বইটি পড়েছি। এর মানে হলো, আমি হুজুরের সামনে বসেছি, হুজুর আরবি পড়ে পড়ে অর্থ করতেন, আর আমি তা শুনেছি।

মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনো বই আরবি অথবা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতে করতেই তাদের ক্লাসের সময় শেষ হয়ে যায়। লেখক যে সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করেছেন, সে সমস্যাগুলো বুঝা এবং এর সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হয় না। ফলে, দিন শেষে একাডেমিক বইগুলোর পাঠক হিসাবে আমরা চরম ব্যর্থ হই, এবং আমাদের নতুন কোনো চিন্তার উদ্ভাবন হয় না।

এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যে একাডেমিক বইগুলোর প্রচুর বাংলা অনুবাদ হওয়া প্রয়োজন। এবং ক্লাসে বাংলা অনুবাদ করা বই থেকেই চিন্তাগুলো পড়ানো প্রয়োজন। তখন কেবল অনুবাদ করতে করতেই ক্লাসের অধিক সময় চলে যাবে না, বরং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা চিন্তা করার প্রচুর সময় পাবেন, এবং তখনি কেবল নতুন নতুন চিন্তা সহজেই উদ্ভাবন হবে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...