সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইজতিহাদ কি বন্ধ হয়ে গেছে? - ইমাম শাফেয়ী

ইসলামী বিষয়ে গবেষণা করা কিংবা ইজতিহাদ করার দরজা কি বন্ধ হয়ে গেছে? গবেষণা করতে গিয়ে কেউ যদি কোনো ভুল করে, তাহলে কি কোনো সমস্যা?

এসব প্রশ্নের দারুণ উত্তর দিয়েছেন ইমাম শাফেয়ী তার রিসালাহ গ্রন্থের ইজতিহাদ অধ্যায়ে। ইমাম শাফেয়ীকে ইজতিহাদ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন একজন, এবং ইমাম শাফেয়ী তার উত্তর দিয়েছেন এই গ্রন্থে। উনাদের কথোপকথন থেকে একটি অংশ অনুবাদ করে দিচ্ছি।

(১৩৭৭)
উপস্থাপক – ইজতিহাদ বা গবেষণা করার জন্যে আপনি কিছু শর্ত উল্লেখ করেছেন। কিন্তু, কিসের ভিত্তিতে আপনি ইজতিহাদকে জায়েজ বলছেন? এর পক্ষে কি কোনো দলীল আছে?

(১৩৭৮)
ইমাম শাফেয়ী – হ্যাঁ। আল্লাহ তায়ালার একটি আয়াতের ভিত্তিতে (আমি ইজতিহাদ করাকে জায়েজ মনে করি)। আল্লাহ তায়ালা বলেন –

وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ

“তুমি যেদিক হতেই বের হও না কেন, মসজিদুল হারাম বা কাবার দিকে মুখ ফিরাও। এবং তুমি যেখানেই থাকো না কেন, ঐদিকে মুখ ফিরাও।“ [সূরা বাকারা - ১৫০]

(১৩৭৯)
উপস্থাপক – এ আয়াতে (شَطْرَهُ) শব্দের মানে কি?

(১৩৮১)
ইমাম শাফেয়ী - ধরুন, কেউ মসজিদুল হারামের দিকে ফিরে নামাজ পড়তে চাইলো, এবং তার অবস্থান কাবা শরীফ থেকে অনেক দূরে, তাহলে তাকে কাবা শরীফের সঠিক দিক নির্ণয়ের জন্যে ইজতিহাদ করতে হবে। নামাজ পড়ার জন্যে কাবার দিকে মুখ করা আবশ্যক, কিন্তু কেউ যদি না জানে কোনদিকে সঠিক আর কোনদিকে ভুল, তাহলে তাকে অন্য মানুষকে জিজ্ঞাস করতে হবে। হতে পারে, একজন বলবে একদিকে, আরেকজন বলবে, না, উল্টো দিকে। এভাবে কাবার দিক নির্ণয়ে মতপার্থক্য হতে পারে। (তাই, একজন ব্যক্তিকে কাবার সঠিক দিক নির্ণয়ের জন্যে ইজতিহাদ করতে হয়।)

(১৩৮২)
উপস্থাপক – আমি যদি আপনার ইজতিহাদের এই বিষয়টা মেনে নেই, তাহলে তো বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য শুরু হবে।

(১৩৮৩)
ইমাম শাফেয়ী – হ্যাঁ। আপনি আপনার মতো বলতে পারেন।

(১৩৮৪)
উপস্থাপক – আমার মতে, ইজতিহাদ করা জায়েজ না।

(১৩৮৫)
ইমাম শাফেয়ী – ধরুন, আমি এবং আপনি দুইজনে কোনো দিকে রওনা হলাম, এবং আমাদের দুইজনের কাছেই পথটা পরিচিত। নামাজের সময় হলে আমি যদি বলি কাবা শরীফ এইদিকে; আর আপনি যদি বলেন, না, ঐদিকে। তখন আমাদের দু’জনের মধ্যে কার কথা অনুসরণ করা হবে?

(১৩৮৬)
উপস্থাপক – এখানে কেউ কাউকে অনুসরণ করতে বাধ্য নয়।

(১৩৮৭)
ইমাম শাফেয়ী – তাহলে এখন আমাদের প্রত্যেকের কি করা উচিত হবে?

(১৩৮৮)
উপস্থাপক – আমি যদি বলি যে, কিবলার সঠিক দিক না জানার আগে নামাজ ফরজ হবে না, তাহলে তারা কখনোই কাবার দিক নির্ণয় করতে পারবে না, কারণ তারা কাবা শরীফ দেখতে পারছে না। ফলে তারা নামাজ কাজা করে ফেলবে।

আবার যদি বলি, নামাজের জন্যে কাবার দিকে মুখ করা ফরজ নয়, যে কোনো একদিকে ফিরে নামাজ পড়লেই হবে। এটাও সঠিক নয়। উপরোক্ত দুটি মতের কোনোটাকেই আমি সঠিক মনে করি না। যেহেতু, এখানে কেউ কারো অনুসরণ করতে বাধ্য নয়, তাই এখন দুইজন-ই তাদের ইজতিহাদ অনুযায়ী নামাজ পড়াকে আমি সঠিক বলে ধরে নিতে হবে।

অথবা, বিষয়টাকে আমি এভাবে বলতে পারি, তারা উভয়ে নামাজ পড়ার জন্যে শারীরিক ও মানসিকভাবে কাবার দিকে ফেরাটা জরুরি। প্রকাশ্য বা শারীরিকভাবে কাবার দিকে মুখ করাটা ভুল হলেও, মানসিকভাবে সে সঠিক আছে।

(১৩৮৯)
ইমাম শাফেয়ী – আপনি যে মত-ই গ্রহণ করুন না কেন, তা আপনার চিন্তার বিপরীত। কেননা, আপনি ইজতিহাদ করার ও মতপার্থক্যের বিরোধিতা করেছেন।

(১৩৯০)
উপস্থাপক – জ্বি, ঠিক।

(১৩৯১)
ইমাম শাফেয়ী – উপরোক্ত দুই পথিকের যে কোনো একজন ভুল দিকে ফিরে নামাজ পড়লে তা জায়েজ হবে বলে আপনি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমি বলি, যদি দুই জনেই ভুল দিকে ফিরে নামাজ পড়ে, তবুও নামাজ হয়ে যাবে।

(এভাবে তাদের বিতর্ক চলতে থাকে। এবং ইমাম শাফেয়ী শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করে দেখান যে, ইজতিহাদ বা গবেষণার পথ বন্ধ নয়, বরং কিছু শর্ত সাপেক্ষে সবার জন্যেই গবেষণার পথ খোলা।)
________________

দেখুন, এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।

১) আমাদের অনেক আলেম বলে, ইজতিহাদের দরজা বন্ধ। অথচ, ইমাম শাফেয়ীর মতে, ইজতিহাদ বা গবেষণা করা ব্যতীত একজন ব্যক্তি নামাজ পর্যন্ত ঠিকভাবে পড়তে পারেন না।

২) ইজতিহাদ ও গবেষণা করতে গেলে মতপার্থক্য বা ভুল হবেই। তাই বলে ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দেননি ইমাম শাফেয়ী।

৩) ইমাম শাফেয়ীর মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কাবা শরীফের ঠিক সামনা সামনি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে না পারবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির-ই ১০০% কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়া সম্ভব না। কিন্তু, গবেষণা বা ইজতিহাদ করে কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়লে, এবং তা ১০০% সঠিক না হলেও নামাজ হয়ে যাবে।

৪) ইমাম শাফেয়ীর মতে, ইজতিহাদ বা গবেষণা যদি ভুলও হয়, তাহলে একগুণ সাওয়াব পাবে, এবং ইজতিহাদ বা গবেষণা যদি সঠিক হয়, তাহলে দ্বিগুণ সাওয়াব পাওয়া যাবে।

অর্থাৎ, ইজতিহাদের দরজা বন্ধ, এ কথা ইমাম শাফেয়ী মানেন না।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্