সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মাজহাব মানা ও জ্ঞানের স্তর বিন্যাস - ইমাম গাজালী

মাজহাব মানা ও জানা সাধারণ মানুষের কাজ নয়, এটা স্কলারদের কাজ।

ইমাম গাজালির মতে, চিকিৎসা শাস্ত্রের মতো ফিকাহ শাস্ত্রও একটি দুনিয়াবি জ্ঞান। তাই, সাধারণ মানুষের জন্যে মেডিক্যালে পড়া যেমন জরুরি নয়, তেমনি ফিকাহ জানাও বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ, ফিকাহের জ্ঞান এবং মাজহাব সম্পর্কে জানা ও মানা হলো ফরজে কিফায়া, সমাজের কয়েকজন ফিকাহ জানলেই হয়, সবার জানার প্রয়োজন নেই।

ইমাম গাজালি ইসলামী জ্ঞানের ৪টি স্তরবিন্যাস করেছেন। প্রথম স্তরের জ্ঞান অর্জনের পর দ্বিতীয় স্তরের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। দ্বিতীয় স্তরের জ্ঞান অর্জনের পর তৃতীয় স্তরে, এবং তৃতীয় স্তরের জ্ঞান অর্জনের পর চতুর্থ স্তরে যেতে হবে। অর্থাৎ, জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ক্রমধারা অবলম্বন করতে হবে।

প্রথম স্তরের জ্ঞান ৪ প্রকার।

১) কোর'আন।
২) রাসূল (স)-এর সুন্নাহ। অর্থাৎ, তাঁর আচার-ব্যবহার, জীবনী ও আমলসমূহ।
৩) ইজমা বা সকল মুসলিম যেসব বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন, তা জানা।
৪) সাহাবীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

কেউ কোর’আন না পড়ে কেবল হাদিস পড়া উচিত নয়, অথবা, কোর’আন ও হাদিস একসাথে পড়তে হবে। এ দুটি মোটামুটি পড়া শেষ হলে, তারপর ইজমা ও সাহাবীদের ইতিহাস পড়তে হবে।

দ্বিতীয় স্তরের জ্ঞান আবার দুই প্রকার।

১) আখলাক বা চারিত্রিক জ্ঞান। অর্থাৎ, একজন মানুষ কিভাবে ভালো গুন অর্জন করতে পারে, এবং খারাপ অভ্যাস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে, সে জ্ঞান। অর্থাৎ, সূফী বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান।

২) পার্থিব কল্যাণ সম্পর্কিত জ্ঞান ও ফিকাহের জ্ঞান।

তৃতীয় স্তরের জ্ঞান।

আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ জানা। অর্থাৎ, ছরফ, নাহু ও বালাগাত ইত্যাদি শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করা।

এখানে সাধারণত একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। কেউ যদি জ্ঞানের তৃতীয় স্তরে এসে আরবি ভাষা শিখে, তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের জ্ঞান অর্জন করবে কিভাবে?

এ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম গাজালি বলেন, রাসূল নিজেও আরবি লিখতে পারতেন না। কেউ যদি কোনো কিছু শুনার সাথে সাথে মুখস্থ করে ফেলতে পারেন, তাহলে তার অক্ষরজ্ঞান থাকা প্রয়োজন নেই।

অবশ্য, ইমাম গাজালি যাদের উদ্দেশে এই কথা বলেছেন, তারা আরবি ভাষা শুনলেই বুঝতে পারতেন। কিন্তু, আমরা তো আরবি ভাষা শুনে বুঝি না। তাই, আমাদের জন্যে অন্তত আরবি ভাষা শুনে বুঝার মতো ক্ষমতা জ্ঞানের প্রথম স্তরেই রাখতে হবে।

কিন্তু, যেহেতু কোর’আন ও হাদিসের মূল বইগুলো বাংলায় অনুবাদ হয়ে গেছে, তাই আগে অনুবাদগুলো শেষ করে পরে আরবি ভাষা শিখতে চাওয়া ভালো। কারণ, কোর’আন ও হাদিস পড়া শেষ না করে আরবি ভাষা শিখতে চাইলে খুব বেশিদিন আগ্রহ ধরে রাখা যায় না।

আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শুরুতেই আরবি ভাষা শেখানোর জন্যে অনেক সময় ব্যয় করা হয়। অথচ, ইমাম গাজালির মতে, কোর’আন ও হাদিসের অর্থ করতে পারার মতো মোটামুটি আরবি ভাষা শেখাটাই যথেষ্ট।

চতুর্থ স্তরের জ্ঞান। এটি আবার কয়েক প্রকার।

১) তাজভীদ। কোর’আন উচ্চারণের জ্ঞান।
২) তাফসীর। কো’আনের ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ। অর্থাৎ, নাসেখ, মনসুখ, আম, খাস ইত্যাদি।
৩) উসুলুল হাদিস। হাদিসের প্রকারভেদ, বর্ণনাকারীদের নাম, বংশ, পরিচয়, গুণাবলী এবং সহীহ হাদিস ও দুর্বল হাদিস ইত্যাদি পার্থক্য করা।
৪) উসুলে ফিকাহ ও বিভিন্ন মাজহাবের আলোচনা। ইসলামকে জানার মেথডলজি জানা।

ইমাম গাজালির মতে, চতুর্থ স্তরের জ্ঞানগুলো হলো ফরজে কিফায়া। সকল মুসলমানের জন্যে এসব জ্ঞান জানা বাধ্যতামূলক নয়। চিকিৎসা শাস্ত্রের মতো সমাজের কিছু আলেম ও স্কলার এসব বিষয়ে জ্ঞান রাখলেই যথেষ্ট।

দেখুন, আমরা যারা ইসলাম নিয়ে সারাদিন বিতর্ক করি, তারা ইসলামী জ্ঞানের সর্বনিম্ন বিষয়গুলো নিয়েই সারাদিন পড়ে থাকি। অথচ, আমারা অনেকে জীবনে একবার সম্পূর্ণ কোর’আন ও ৬টি হাদিস গ্রন্থের কেবল অর্থটাও পড়ে দেখিনি।

মাজহাব জানা ও মানা, এবং কোনটা সহিহ হাদিস ও কোনটা দুর্বল হাদিস এসব খুঁজে বের করা স্কলারদের কাজ। কেউ যদি জ্ঞান অর্জনের ক্রমধারা অবলম্বন করে, অর্থাৎ প্রথমে কোর’আন, এরপর সুন্নাহ ও রাসূলের জীবনী, এরপর মুসলিমদের ঐক্যমত্যের বিষয়গুলো, এরপর সাহাবীদের জীবনী ও ঐতিহ্য, এরপর নিজের খারাপ অভ্যাসগুলো দূর করার জ্ঞান, এরপর আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ, এরপর তাজভীদ, এরপর তাফসীর, এরপর হাদিস বর্ণনাকারীদের নাম ও পরিচয়, এরপর সহীহ হাদিস ও দুর্বল হাদিস এবং সর্বশেষ এসে যদি মাজহাব নিয়ে কথা বলে, তাহলে ঠিক আছে। অন্যথায়, মাজহাব মানা বা না-মান এসব নিয়ে কথা বললে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
______
লেখার সূত্রসমূহ
الضرب الأول الأصول وهي أربعة كتاب الله عز وجل وسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم وإجماع الأمة وآثار الصحابة والإجماع

وهذا على ضربين أحدهما يتعلق بمصالح الدنيا ويحويه كتب الفقه والمتكفل به الفقهاء وهم علماء الدنيا والثاني ما يتعلق بمصالح الآخرة وهو علم أحوال القلب وأخلاقه المحمودة والمذمومة

والضرب الثالث المقدمات وهي التي تجري منه مجرى الآلات كعلم اللغة والنحو فإنهما آلة لعلم كتاب الله تعالى وسنة نبيه صلى الله عليه وسلم وليست اللغة والنحو من العلوم الشرعية في أنفسهما

الضرب الرابع المتممات وذلك في علم القرآن فإنه ينقسم إلى ما يتعلق باللفظ كتعلم القراءات ومخارج الحروف وإلى ما يتعلق بالمعنى كالتفسير فإن اعتماده أيضاً على النقل إذ اللغة بمجردها لا تستقل به وإلى ما يتعلق بأحكامه كمعرفة الناسخ والمنسوخ والعام والخاص والنص والظاهر وكيفية استعمال البعض منه مع البعض وهو العلم الذي يسمى أصول الفقه ويتناول السنة أيضاً

وأما المتممات في الآثار والأخبار فالعلم بالرجال وأسمائهم وأنسابهم وأسماء الصحابة وصفاتهم والعلم بالعدالة في الرواة والعلم بأحوالهم ليميز الضعيف عن القوي والعلم بأعمارهم ليميز المرسل عن المسند وكذلك ما يتعلق به فهذه هي العلوم الشرعية وكلها محمودة بل كلها من فروض الكفايات

[إحياء علوم الدين 1/ 17]

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্