সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আশয়ারি মেথডলজি প্রতিষ্ঠার কারণ

আশয়ারি মেথডলজি সম্পর্কে একজন ভাইয়া জানতে চেয়েছেন। তাঁর জন্যেই এ লেখা।

পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম আশয়ারি স্কুলের মেথডলজি অনুসরণ করেন। উস্তাদ ইউছুফ আল কারাদাভীর মতে, কেবল মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং তিউনেশিয়ার জাইতুনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ও ভারতের দেওবন্দী মাদ্রাসাসমূহ, নদওয়াতুল উলামার আলেমগণ, এবং পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলো সহ সারা বিশ্বের সকল ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আশয়ারি স্কুলের মেথডলজি অনুসরণ করে। অন্যদিকে, খুব অল্প সংখ্যক মুসলিম সালাফী মেথলডজি অনুসরণ করেন। এমনকি সৌদি আরবের সব আলেমও সালাফী মেথডলজি অনুসরণ করেন না।

আশয়ারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ইমাম আবুল হাসান আল আশয়ারি। তাঁর নাম অনুসারেই এ স্কুলের নাম আশয়ারি রাখা হয়।

ইমাম আশয়ারি জীবনের ৪০ বছর পর্যন্ত মুতাজিলা মেথডলজি চর্চা করেন। এমনকি মুতাজিলা মেথডলজির অনেক বড় আলেমও ছিলেন তিনি।

একবার ইমাম আশয়ারি তাঁর উস্তাদ আলী আল জুব্বায়ীর সাথে বিতর্কে শুরু করেন; এবং উস্তাদ তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে না পারায় তিনি মুতাজিলা চিন্তাধারা থেকে সরে আসেন। উস্তাদের সাথে এই বিতর্কটি “তিন ভাইয়ের মাসয়ালা” হিসাবে পরিচিত।

এখানে 'তিন ভাইয়ের গল্পটা' একটু বলি।

ইমাম আশয়ারী তাঁর মুতাজিলা উস্তাদ আলী আল জুব্বায়ীকে একটা প্রশ্ন করেন - ধরুন, কোনো দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিন ভাই মারা গেলো। বড় ভাইটা খুব নামাজ-রোজা পালন করতো, এবং খুব ভালো ছিলো। মেজো ভাইটা খুব খারাপ ছিলো, এমনকি নামাজ-রোজাও পালন করতো না। আর, ছোট ভাইটার এখনো ইবাদাত করার বয়স হয়নি। আখিরাতে এই তিন ভাই কে কোথায় যাবে?

উস্তাদ আলী আল জুব্বায়ী বলেন, “বড় ভাইটা তার ভালো কর্মের কারণে জান্নাতে যাবে, মেজো ভাইটা তার খারাপ কর্মের কারণে জাহান্নামে যাবে, এবং ছোট ভাইটা যেহেতু কোনো ইবাদাতও করেনি, আবার কোনো খারাপ কাজও করেনি, তাই সে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি স্থানে থাকবে।”

ইমাম আশয়ারী বলেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন যদি ছোট ভাইটা প্রশ্ন করে, "হে আল্লাহ তুমি আমাকে ছোট অবস্থায় মৃত্যু দিলে কেন? আমি যদি বড় হতাম, তাহলে তোমার ইবাদাত করতাম, এবং আমার বড় ভাইয়ার সাথে আমিও জান্নাতে যেতে পারতাম।" ছোট ভাইয়ের উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ তায়ালা কিভাবে দিবেন?

উস্তাদ জুব্বায়ী বলেন, “আল্লাহ তায়ালা ছোট ভাইটাকে বলবেন, শুনো, তুমি বড় হয়ে খারাপ কাজ করতে এবং তোমার মেজো ভাইয়ের মতো জাহান্নামে যেতে। তাই তোমাকে ছোট অবস্থায় মৃত্যু দিয়েছি, যাতে তুমি জাহান্নামে যেতে না হয়।”

ইমাম আশয়ারী এবার তাঁর উস্তাদকে বলেন, আচ্ছা, এখন মেজো ভাইটা যদি আল্লাহকে বলে যে, "হে আল্লাহ আমাকে কেন আমার ছোট ভাইয়ের মতো ছোট বেলায় মৃত্যু দাওনি? যদি আমাকে ছোট বেলায় মৃত্যু দিতে, তাহলে তো আমাকে আজ জাহান্নামে যেতে হতো না।" মেজো ভাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ কি জবাব দিবেন?”

ইমাম আশয়ারীর এই প্রশ্ন শুনে উস্তাদ জুব্বায়ী কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

ফলে ইমাম আশয়ারী বুঝলেন যে, মুতাজিলা মেথডলজি দিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। তাই তিনি মুতাজিলা মেথডলজি ত্যাগ করে কিছুদিন হাম্বলি মেথডলজি অনুসরণ করেন।

কিন্তু হাম্বলী মেথডলজিতে যুক্তি-বুদ্ধির সুযোগ কম থাকায় পরবর্তীতে তিনি হাম্বলী মেথডলজিও ত্যাগ করেন। এবং নিজেই একটি চিন্তার মেথডলজি প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে আশয়ারি মেথডলজি হিসাবে পরিচিতি পায়।

ইমাম আশয়ারীর পরে ইমাম আবু বকর বাকিল্লানী এই স্কুলের হাল ধরেন, এবং এই মেথডলজিকে আরো সমৃদ্ধ করেন। পরবর্তীতে ইমাম গজালির মাধ্যমে এই মেথডলজিটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

এ কারণে, ইউসুফ আল কারাদাভী বলেছেন, আল আজহার, জাইতুনা ও দেওবন্দ সহ সারা বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম আশয়ারি মেথডলজি অনুসরণ করেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...