সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার ধারণা

বাংলাদেশে মোটাদাগে দুই ধরণের রাজনীতি রয়েছে। একটি ধর্মহীন রাজনীতি, অন্যটি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। সঠিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি বাংলাদেশে কখনোই ছিলো না। অর্থাৎ, তুরস্কের একে পার্টি কিংবা তিউনিসিয়ার আন-নাহদা পার্টির মতো ধর্মনিরপেক্ষ একটি দল বাংলাদেশে নেই।

ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীন বা ধর্ম-বিদ্বেষ নয়, ধর্ম নিরপেক্ষ মানে অধিকারের প্রশ্নে সকল ধর্মের প্রতি সমান আচরণ।

ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়টা বুঝার জন্যে ইসলাম থেকে অনেকগুলো উদাহরণ দেয়া যায়।

এক।

বশীর ইবনে উবাইরিক বা তা'মাহ নামের এক মুসলিম অন্য এক আনসার মুসলিমের একটি বর্ম চুরি করে। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু হলে তা'মাহ সে চোরাই মালটি এক ইহুদীর কাছে রেখে আসে।

বর্মের মালিক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে অভিযোগ করে এবং মুসলিম তা'মাহকে সন্দেহ করে। কিন্তু তা'মাহ, তার ভাই বেরাদাররা এবং বনি যাফরের আরো বহু মুসলমান নিজেদের মধ্যে একমত হয়ে নিজের দোষ ঐ ইহুদীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। ইহুদী লোকটিকে জিজ্ঞেস করা হলে সে নিজের নির্দোষিতা প্রকাশ করে। কিন্তু তা'মাহর লোকেরা তার পক্ষে জোরেশোরে সমর্থন দিতে থাকে, এবং তারা বলতে থাকে: "এই শয়তান ইহুদী, সেতো সত্যকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে কুফরি করে, তার কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বরং রাসূল (স)-কে আমাদের কথা মেনে নেয়া উচিত, কারণ আমরা মুসলমান।"

মুসলিমদের কথায় বেশি যুক্তি দেখে রাসূল (স) তা'মাহ-এর পক্ষে, এবং ইহুদি লোকটির বিপক্ষে রায় দিচ্ছিলেন, ঠিক এমন সময় কোর'আনের এই আয়াতটি নাযিল হয়।

إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ ۚ وَلَا تَكُن لِّلْخَائِنِينَ خَصِيمًا

"হে নবী! আমি সত্য সহকারে তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আল্লাহ তোমাকে যে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তুমি লোকদের মধ্যে ফায়সালা করতে পারো। তুমি খেয়ানতকারীর পক্ষ হয়ে বিতর্ক করো না।" [সূরা নিসা - ১০৫]

উপরোক্ত ঘটনার জন্যে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল (স)-কে ক্ষমা চাইতে বলেন। [দেখুন, তাফহীমুল কোর'আন]

দুই।

কোর'আনে মূসা (আ)-এর একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। মূসা (আ) যখন যুবক ছিলেন, তখন একদিন দেখলেন, দুই ব্যক্তি মারামারি করছে। এদের মাঝে একজন মূসা (আ)-এর নিজের দলের, এবং অন্য জন শত্রু দলের। মূসা (আ)-এর নিজের দলের লোকটি মূসা (আ)-কে ডাকলেন তার শত্রুকে মারধর করার জন্যে। মূসা (আ) তার শত্রু দলের লোকটিকে একটা ঘুষি মারলেন, এবং লোকটি সাথে সাথেই মারা যায়।

মূসা (আ)-এর শত্রু দলের লোকটি মারা যাবার সাথে সাথেই মূসা (আ) নিজের ভুল বুঝতে পারেন। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান।

পরের দিন আবার যখন মূসা (আ)-এর নিজের দলের লোকটি মূসা (আ)-কে মারামারি করার জন্যে আহবান করেন, তখন মূসা (আ) বলেন - "তুমি তো একজন প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট ব্যক্তি।" [সূরা কাসাস - ১৫ থেকে ১৮]
__________

উপরোক্ত দুটি ঘটনা থেকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ ধারণাটি বুঝতে পারি।

১) কিছু মুসলিম আছে, যারা ইসলামী রাষ্ট্র থেকে অন্যায়ভাবে অধিক অধিকার পেতে চায়। এবং বিধর্মী বা শত্রু পক্ষকে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করে, নিজেরা মুসলিম এই দোহাই দিয়ে বেঁচে যেতে চায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ইনসাফ কায়েম করতে হবে ধর্মনিরপেক্ষভাবে। অর্থাৎ, কেউ নিজের ধর্মের বা নিজের দলের লোক হলেই রাষ্ট্র থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে না।

২) ধর্মনিরপেক্ষ মানে আইন ও অধিকারের প্রশ্নে সকল ধর্মের সাথে সমান আচরণ করা। কিন্তু, ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীন বা ধর্মবিদ্বেষী হওয়া নয়।

৩) রাসূল (স) যখন জীবিত ছিলেন, তখন তাঁকে ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়েছে, কে সঠিক আর কে বেঠিক। এখন যেহেতু রাসূল (স) নেই, তাই নিজ ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত মায়ার কারণে আমরা অনেক সময় ইনসাফ বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারি। তাই রাষ্ট্রকে ইনসাফ কায়েম করতে হবে ধর্ম-নিরপেক্ষভাবে।

৪) বাংলাদেশে ধর্মহীন কিছু দল আছে, এবং ধর্মভিত্তিক কিছু দল আছে। কিন্তু, সঠিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ কোনো দল নেই। তাই এখন সময়ের দাবী হলো, সঠিক অর্থে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল গঠন করা।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...