সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে শায়েখ হামজা ইউসুফ

ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে শায়েখ হামজা ইউসুফ বলেন –

"আধুনিক যুগের মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলাম হলো একটি রাজনৈতিক দর্শন। আসলে এটি জায়োনিস্টদের একটি দাবী। জায়োনিস্টরা ইহুদি ধর্মকে একটি রাজনৈতিক দর্শনে পরিবর্তন করে ফেলেছে।

কেয়ামতের একটি আলামত হিসাবে রাসূল (স) বলেছেন যে, "তোমরা (মুসলিমরা) তখন বনি ইসরাইল অনুসরণ করবে। এবং তোমরা বনী ইসরাইলের মতো হয়ে যাবে।"

এখন বনী ইসরাইল যেমন একটি ইহুদি রাষ্ট্র চায়, তেমনি আধুনিক মুসলিমরাও একটি ইসলামী রাষ্ট্র চায়।

ইসলামী রাষ্ট্র হলো এমন একটা ভুল আইডিয়া, যেখানে আপনি মানুষকে ভালো মুসলিম হবার জন্যে চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন। এমন কোনো ধারণার অস্তিত্ব ইসলামে কখনোই ছিলো না, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না। যদি আপনি মনে করেন যে, রাষ্ট্র ও সরকারের মাধ্যমে ইসলামী শরিয়াহকে বাস্তবায়ন করবেন, তাহলে আপনি সম্পূর্ণ ভ্রান্তির মধ্যে আছেন।

কারণ আল্লাহ তায়ালা কোর'আনে বলছেন –

وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَن فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا ۚ أَفَأَنتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ

"তোমার প্রভু ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সকল মানুষ ঈমান গ্রহণ করতো। তুমি মানুষকে মুমিন হবার জন্যে জবরদস্তি করবে?" [সূরা ১০/ ইউনুস - ৯৯]

ইসলাম হলো একটি অন্তর্গত পদ্ধতি। সরকার বা রাষ্ট্র দিয়ে মানুষকে মুমিন বানানো যায় না। মানুষের অন্তর পরিবর্তন করার মাধ্যমে মুসলিম বানাতে হয়।

একটি সরকার সর্বোত্তম যে কাজটি করে, তা হলো একটি কোর্ট ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা, যার মাধ্যমে ঘুষ আদান-প্রদান করা বন্ধ করা যাবে।

যদিও রাসূল (স) বলেছেন - "প্রতি ৩ জন বিচারকের মাঝে ২ জন জাহান্নামে যাবে"। বিচারক হওয়াটা খুব ভালো কাজ নয়। এ কারণে অতীতের মুসলিম স্কলারগণ কখনোই বিচারক হতে চাইতেন না।

ইসলামী শরিয়তের চার ইমামের সবাই ছিলেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, এবং তাঁরা কখনো রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেননি। আহমদ বিন হাম্বল একটু সরকারের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু সেটি রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং আকীদার কারণে। তখন যারা ক্ষমতায় ছিলো তাদেরকে মুতাজিলা সম্প্রদায় এটা বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে, কোর'আন হলো আল্লাহর সৃষ্টি। এ কারণে আহমদ বিন হাম্বল তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে বলেছিলেন, কোর'আন সৃষ্টি নয়।

ইমাম আবু হানিফা রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, এবং এর জন্যে তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিলো। এ ছাড়া আপনি যদি ইমাম মালিকের মুদাওয়ানা গ্রন্থটি সম্পূর্ণ পড়ে দেখেন, সেখানে আপনি তাঁর রাজনৈতিক একটি বক্তব্যও খুঁজে পাবো না। তিনি কেবল একটি কারণে অভিযুক্ত ছিলেন, আর তা হলো নবী পরিবারের সদস্য মুহাম্মাদ নাফস জাকিয়ার প্রতি তার সহানুভূতি ছিলো।

ইমাম মালিকের কোনো রাজনৈতিক অবস্থান ছিলো না, তিনি কেবল মানুষকে শরিয়াহ শিক্ষা দিয়েছেন। কেউ যদি তার শরিয়তের শিক্ষা গ্রহণ করতো, তাহলে তিনি তাকে স্বাগতম জানাতেন। আর কেউ যদি তার শরিয়তের শিক্ষাকে গ্রহণ না করতো, তাহলে তার আখিরাতে জন্যে দোয়া করতেন। এটাই ধর্মের পথ ও পদ্ধতি। ধর্মকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

কখনো কোনো স্কলার যদি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে তিনি রাজনীতি দ্বারা কলুষিত হয়ে যাবেন। কারণ, এটাই হলো বিশ্বের নিয়ম।

রাজনীতিতে দুর্নীতির উপাদান রয়েছে। তাই ধর্মকে রাজনীতির সমসাময়িক বিষয়গুলোর সাথে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। ধর্মকে সবসময় একটা স্থায়ী মর্যাদা দিতে হবে।

ইসলাম কখনো কোনো মোল্লাতন্ত্র বা পাদ্রি সমাজ সৃষ্টি করেনি। ইসলাম ধর্মের আইডিয়া হলো, এখানে প্রতিটি নারী ও পুরুষ তাঁদের সর্বোচ্চ সমর্থ অনুযায়ী আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার চেষ্টা করা উচিত। ইসলামে পাদ্রীদের মতো এমন কোনো গ্রুপ নেই, যাদের কথা আপনাকে শুনতেই হবে।

ইসলামে যে কোনো ব্যক্তি স্কলার হতে পারে। এতে কোনো বিধিনিষেধ নেই। কেউ যদি ভালোভাবে পড়াশুনা করেন, এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি একটি ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারেন। খ্রিষ্টান ধর্মের মতো ইসলাম ধর্মের এমন কোনো অফিসিয়াল রূপ নেই যে, পাদ্রী বা হুজুর যা বলবেন, সবাইকে তাই সবাইকে মেনে নিতে হবে। ইসলামী স্কলারগন একে অপরের চেয়ে ভিন্ন মত পোষণ করতেন। কেউ বলেছেন, এটা ঠিক; কেউ বলেছেন, এটা না, ওটা ঠিক। মানুষ তাঁদের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে বুঝবে আসলে কোনটি ঠিক আর কোনটি ঠিক না।

ইসলামী রাষ্ট্রের এই আধুনিক ধারণাটা আসলেই দুর্ভাগ্যজনক। এটা মুসলিমদের জীবনে অনেক খারাপ প্রভাব ফেলছে।
মুসলিম ফকিহ ও আলেমগণ আইনবিদদের মতোই ভূমিকা পালন করতে পারেন। রাষ্ট্রীয় কাজে নিযুক্ত বিচারকগণ জানেন, কিভাবে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করার জন্যে আইনের অপব্যবহার করতে হয়।
অতীতের সুলতানদের সবসময়ে দু'একজন অফিসিয়াল মোল্লা ছিলেন, যারা ইসলাম নয়, বরং সুলতানের ইচ্ছানুযায়ী ফতোয়া দিতেন। এটা এখনো আছে। অনেকেই সরকারের পাশে থেকে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী ফতোয়া দেন।

মুসলিম স্কলারদের কাজ সরকারকে পরামর্শ দেয়া, এবং সরকার কোনো ভুল করলে তার সমালোচনা করা; কিন্তু নিজেই সরকার গঠন করবে না কিংবা নিজেই সরকারের অংশ হয়ে যাবে না। যেহেতু অধিকাংশ শাসক-ই অত্যাচারী হয়ে থাকে, তাই একজন আলেমের উচিত অত্যাচারী সরকারের সামনে গিয়ে সত্য কথা বলে আসা, কিন্তু সরকারী মোল্লা হওয়া উচিত নয়। একজন সত্যিকার আলেম রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা এমনভাবে পালিয়ে যান, যেভাবে মানুষ একটি সিংহ থেকে পালিয়ে যায়।

আমরা মনে করি, ইসলামের ইতিহাসে অধিকাংশ মুসলিমদের জন্যে রাজনীতি কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। অধিকাংশ ইসলামী স্কলারগণ সবসময় শরিয়াহর মাধ্যমে সমাজের ঐক্য ও সঙ্গতির জন্যে কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁরা কখনো শরিয়াহকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করেননি। আমরা যদি অতীতের মুসলিম স্কলারদের বই-পুস্তক পড়ি, তাহলে দেখবো যে, তাঁরা সমাজের মানুষদেরকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার জন্যে কখনো কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করেননি।

নৈতিকতা ও সৎ আদর্শ তৈরি হয় পরিবার থেকে, যেখানে শিশুরা বেড়ে ওঠে। কিভাবে বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর উপর নির্ভর করে সন্তানের চরিত্র। অনেক বাবা-মা নিজেরাই সৎ নন। অনেক সন্তান দেখেন, তাঁদের বাবা-মা মিথ্যা বলছেন, খারাপ কাজ করছেন, তাই সন্তানরাও বাবা-মায়ের অনুসরণ করে খারাপ হয়ে যায়।

(অর্থাৎ, রাষ্ট্রের মাধ্যমে মানুষকে ভালো মুসলিম বানানো যায় না, মানুষকে ভালো মুসলিম বানাতে হয় পরিবার থেকেই)

https://www.youtube.com/watch?v=jlt8s9wrggY&t=219s&fbclid=IwAR1nF-wi0heKg1VHSZb6bRubicX6M0HBE6sfr-IJSX1c76ioLRVME2mgfhM

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...