সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইমাম আহমদ বিন হাম্বলকে কাফির ঘোষণা দিয়েছে কারা?

ইসলামের ইতিহাসে যত ইমাম বা স্কলারের কথা আমরা শুনি, সবাইকেই তাদের যুগের মুফতিরা কাফের ফতোয়া দিয়েছিলেন। যেমন, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেছিলেন - "কোর'আন আল্লাহর মতোই আদি ও অনন্ত"। এ কথা বলার কারণে ইমাম আহমদ বিন হাম্বলকে ভ্রান্ত ও কাফির মনে করতো তৎকালীন মুফতিরা। শুধু তাই নয়, ইমাম আহমদ তাঁর এ মত প্রকাশ করার কারণে প্রায় ৩০ মাস তাঁকে কারাগারে আটক রাখা হয়, এবং নির্যাতন করা হয়। এ কাজটি কিন্তু তৎকালীন শাসক খলিফা মামুন তার নিজের ইচ্ছায় করেননি, মুফতিদের ফতোয়ার ভিত্তিতেই ইমাম আহমদকে শাস্তি দেয়া হয়েছিলো।


খলিফা মামুন মারা যারার পর ইমাম আহমদকে খলিফা মুতাসিমের কাছে পাঠানো হয়। খলিফা মুতাসিম ইমাম আহমদের উপর কিছুটা সদয় ছিলেন। কিন্তু, খলিফার দরবারে বসা মুফতি ও মুহাদ্দিসরা ইমাম আহমদের সাথে যুক্তি তর্কে না পেরে খলিফাকে বললেন - "হে আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহর কসম! এই ব্যক্তি (ইমাম আহমদ) নিজে ভ্রান্ত, অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে, এবং সে একজন বিদায়াতপন্থী লোক। এখানে আপনার দরবারে অনেক বড় বড় বিচারক, আলেম ও মুফতি রয়েছে। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞাস করুন।"

খলিফা মুতাসিম যখন তার দরবারে বসা মুফতি-মাওলানা-শায়েখদের জিজ্ঞাস করলেন, "আহমদ বিন হাম্বলের ব্যাপারে তাদের মতামত কি?" তখন সবাই একসাথে বলেছিলো - "আহমদ বিন হাম্বল আসলেই একজন ভ্রান্ত, বিদায়াতি ও কাফের।"(১)

শুধু তাই নয়, তৎকালীন কিছু মুহাদ্দেছ বা হাদিসের শায়েখ ইমাম আহমদকে এই বলে কটাক্ষ করতেন যে, আহমদ বিন হাম্বল হাদিস জানে না। দুর্বল হাদিস দিয়ে রেফারেন্স দেয়।(২)

ইমাম আহমদকে যেন কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া না হয়, সে জন্যে তৎকালীন মুফতি-মুহাদ্দিস-মাওলানা-শায়েখরা মিলে খলিফা মুতাসিমকে বলেন - "হে আমীরুল মুমিনীন! এই লোকটা কাফির, ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকারী। এটা খেলাফত পরিচালনার নীতি হতে পারে না যে, আপনি তাকে ছেড়ে দিবেন, আর সে দুইজন খলিফার উপর জয়লাভ করবে"(৩) -এ কথা শুনার পর খলিফা মুতাসিম ইমাম আহমদের উপর থেকে তার সদয় ভাব উঠিয়ে নেন, এবং ইমাম আহমদকে চাবুক মারার জন্যে আদেশ করেন।

এভাবে প্রতিটি যুগেই ছোট-খাটো মুফতি-মাওলানারা বড় বড় স্কলারদেরকে কাফির, মুরতাদ, বিদায়াতি ও ভ্রান্ত এসব বলতেন। কিন্তু পরবর্তীতে এসব 'ভ্রান্ত' স্কলারগণ-ই অমর হয়ে থাকেন।

সূত্র -

(১)
هُوَ وَاللَّهِ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ ضالٌ مضلٌ مبتدعٌ، وهنا قُضَاتُكَ وَالْفُقَهَاءُ فَسَلْهُمْ، فَقَالَ لَهُمْ: مَا تَقُولُونَ؟ فَأَجَابُوا بِمِثْلِ مَا قَالَ ابْنُ أَبِي دُؤَادٍ،
[البداية والنهاية ط إحياء التراث 10/ 367]
(২)
عن بعض المحدثين كاملا يَتَسَلَّقُونَ بِهِ إِلَى الطَّعْنِ فِيهِ،
[البداية والنهاية ط إحياء التراث 10/ 367]
(৩)
فَلَمَّا لَمْ يَقُمْ لَهُمْ مَعَهُ حُجَّةٌ عَدَلُوا إِلَى اسْتِعْمَالِ جَاهِ الْخَلِيفَةِ، فقالوا: يا أمير الْمُؤْمِنِينَ هَذَا كَافِرٌ ضَالٌّ مُضِلٌّ. وَقَالَ لَهُ إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ نَائِبُ بَغْدَادَ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ لَيْسَ مِنْ تَدْبِيرِ الْخِلَافَةِ أَنْ تُخَلِّيَ سَبِيلَهُ وَيَغْلِبَ خَلِيفَتَيْنِ، [البداية والنهاية ط إحياء التراث 10/ 368]

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...