সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট কি? (নাকিব আল আত্তাস এর সাক্ষাতকার)

শায়েখ হামজা ইউসুফ : প্রথমেই বলে নিচ্ছি যে, আমি আপনার চিন্তা দ্বারা অনেক উপকৃত হয়েছি। আপনার যতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে, সবগুলো বই আমি পড়েছি। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন হলো, বর্তমান মুসলিম বিশ্বের মৌলিক সংকট কি?

সাইয়েদ নাকিব আল আত্তাস : আমি আমার বইগুলোতে বলেছি, বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট হলো আদবের সঙ্কট। এখানে আমি "আদব" শব্দটিকে ক্লাসিক্যাল অর্থে ব্যবহার করছি। আদব হলো প্রজ্ঞার প্রতিফলন। কারণ, আদব আসে নবীদের জ্ঞান থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি আদব শিখতে পারবেন না। এমনকি, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেও আদব অর্জন করা যায় না। এ কারণে আপনি দেখবেন, কিছু মানুষের জ্ঞান থাকলেও তাদের আদব নেই।

আমার কাছে আদবের সংজ্ঞা হলো এমন – 'ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করাকে আদব বলে'। এখানে 'ন্যায়' বলতে আমি বুঝাচ্ছি সকল ভালো গুণাবলীর সমষ্টিকে। ন্যায় হলো সকল ভালো গুণাবলীর সমষ্টি, তাই এটি সকল ভালো গুণাবলীর শীর্ষে অবস্থান করে। এ কথাটা কোর'আনেও বলা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন - "নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতের হকদারকে তাদের আমানাত ফিরিয়ে দাও। আর তোমরা মানুষের মাঝে যখন বিচার-মীমাংসা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।" [সূরা ৪/নিসা - ৫৮]

এ আয়াতে চারটি পরিভাষা রয়েছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পরিভাষাটি হলো 'আমর'। আমর শব্দের অর্থ আদেশ। সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ, এ দুটি কাজকেই আমরা 'আমর'-এর অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। আপনি যখন 'আমর' শব্দটি বলবেন, তখন আসলে আইন শব্দটিকে বুঝায়। মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করে, তাই মানুষের জন্যে আইন রয়েছে। মানুষ যখন কোনো বিষয়ের আদেশ বা নিষেধ করে, তখন ‘আইন’ পরিভাষাটির প্রয়োজন হয়।

দ্বিতীয় পরিভাষাটি হলো 'আহাল'। আহাল দ্বারা দক্ষ, যোগ্য এবং কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিদেরকে বুঝায়। উলুল ইলম (জ্ঞানের অধিকারী), উলুল আবসার (দূর দৃষ্টির অধিকারী), উলুল আলবাব (প্রতিভাবান), ইত্যাদি শব্দগুলো কোর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই কর্তৃত্বশীল ও ক্ষমতার অধিকারী। কারণ, এরাই মানুষের জন্যে আইন তৈরি করে। ‘আহল’ শব্দটি দিয়ে আপনি সরকারকেও বুঝাতে পারেন।

তৃতীয় পরিভাষাটি হলো 'হাকাম'। হাকাম শব্দটি হিকমাহ শব্দের সাথে সম্পর্কিত। হিকমাহ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা। যেমন, কোর'আনে বলা হয়েছে, "আর তোমরা মানুষের মাঝে যখন বিচার-মীমাংসা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।" [সূরা ৪/নিসা - ৫৮]

হিকমাহ বা প্রজ্ঞা শব্দটি নিয়ে আমি অনেক কাজ করেছি। প্রজ্ঞা হলো এমন জ্ঞান, যা দ্বারা আপনি বুঝতে পারবেন, কোন জিনিসটি কোথায় মানানসই হয়। অর্থাৎ, উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত জিনিসটি রাখতে পারার জ্ঞানকেই প্রজ্ঞা বলে। প্রত্যেক নবী ও রাসূলকেই আল্লাহ তায়ালা হিকমাহ বা প্রজ্ঞা দান করেছেন। যেমন, কোর'আনে বলা হয়েছে, নবীদেরকে কিতাব ও হিকমাহ দান করা হয়েছে। এমন কোনো নবী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়নি। কোর'আনে আল্লাহ বলেছেন, তিনি যার উপর সন্তুষ্ট তাঁকে প্রজ্ঞা দান করেন। এবং যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয়, তার জন্যে প্রচুর কল্যাণ থাকে। [সূরা বাকারা - ২৬৯]

কোর'আনে বলা হয়েছে, লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে। অবশ্য লোকমান নবী ছিলেন না। তাই আমি বিশ্বাস করি, প্রাচীন দার্শনিকদের কেউ কেউ অমুসলিম হলেও, তাদেরকে হিকমাহ বা প্রজ্ঞা দান করা হয়েছিলো। তাদেরকে হয়তো তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা দান করা হয়নি, কিন্তু প্রাকটিক্যাল প্রজ্ঞা দান করা হয়েছিলো। তারা তাদের প্রজ্ঞাকে কেবল অভিজ্ঞতালব্ধ জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা এরিস্টটলের কথা বলতে পারি। তিনি যা করেছেন, তা প্রজ্ঞার-ই বহিঃপ্রকাশ। তিনি জ্ঞান ও যুক্তির প্রকারভেদ করেছেন, এবং এগুলোকে সমৃদ্ধ করেছেন।

প্রাচীন দার্শনিকরা নিজেরাও হয়তো বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেননি। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, এগুলো তাদের নিজেদের চিন্তা থেকে আসতেছে। কিন্তু আসলে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রজ্ঞা প্রাপ্ত না হলে কেউ এগুলো করতে পারেন না।

প্রাচীন দার্শনিকরা যুক্তি ও বুদ্ধি নিয়ে কথা বলেছেন, বিভিন্ন বস্তুর মাঝে পার্থক্য করেছেন, যেমন, যেসব বস্তু বিকশিত হতে পারে, কিন্তু স্থানান্তরিত পারে না, সেগুলোকে গাছপালা হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করেছেন। এবং যেসব বস্তু বিকশিত ও স্থানান্তরিত হতে পারে, সেগুলোকে পশুপাখি হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করেছেন। এ ছাড়া, এক প্রাণীর সাথে অন্য প্রাণীর পার্থক্য কি? এক বস্তু সাথে অন্য বস্তুর পার্থক্য কি? এসব নিয়েও তারা চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এ কাজগুলো কেবল প্রজ্ঞাবান লোকদের-ই কাজ। আল্লাহ তায়ালা প্রজ্ঞা দান না করলে কেউ এসব করতে পারতেন না।

যাই হোক, প্রজ্ঞা হলো প্রত্যেক বস্তুকে তার উপযুক্ত স্থানে রাখার জ্ঞান। যেমন, কোর’আনে বলা হয়েছে, "আমাদের প্রত্যেকের জন্যে মাকামে মালুম বা নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে"। [৩৭/১৬৪]

এরপর, চতুর্থ পরিভাষাটি হলো ‘হক’। কোর'আনে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা সবকিছু 'হক' বা যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। এখানে ‘হক’ শব্দের অর্থ কেবল 'সত্য' নয়, হক অর্থ বাস্তব ও সত্য। এ দুটি শব্দকে মিলিয়ে আমি ‘হক’ শব্দের অর্থ বলি - 'বাস্তবসত্য'। অর্থাৎ, অবাস্তব কোনো কিছু সত্য হতে পারে না। কোনো কিছু সত্য হবার জন্যে সেটা বাস্তব হতে হয়। সত্য কেবল একটা অনুমান বা ধারণা নয়, বরং সত্যের মানেই হলো বাস্তবতা।

এবার, আদবের সংজ্ঞায় আসি। প্রতিটি বস্তুকে যখন আমরা তার উপযুক্ত স্থানে হক-ভাবে রাখার জ্ঞান অর্জন করতে পারবো, তখন আমাদের প্রজ্ঞা অর্জিত হয়। আর যখন আমাদের প্রজ্ঞার দ্বারা আমরা কোনো কাজ করতে পারি, তখন সে কাজটাকে আদব বলা হয়। আর যখন আমরা আদবের সাথে কোনো কাজ করতে পারি, তখন আদল বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

এখানে সারমর্ম কথা হলো, প্রজ্ঞার সাহায্যে প্রতিটি ব্যক্তি ও বস্তুকে তার উপযুক্ত স্থান দেয়ার যে আদব ইসলামে অতীতে ছিলো, তা এখন মুসলিম বিশ্ব থেকে হারিয়ে গেছে। ফলে এখন আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না। আর, এ কারণেই আমি বলেছি, বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের সমস্যা হলো আদবের সঙ্কট।

সম্পূর্ণ বক্তব্য দেখুন।

https://www.youtube.com/watch?v=L5pyXqZq4E0&t=189s

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্