সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ড. সাইয়্যেদ হোসাইন নসের

সত্য ও সুন্দরের ব্রত নিয়ে জ্ঞানের পথে ছুটে চলা এক দুরন্ত পথিকের নাম সাইয়্যেদ হোসাইন নাসের। তিনি একাধারে ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং অসংখ্য ইসলামী বইয়ের লেখক। তাঁর গভীর ও মৌলিক চিন্তা-ভাবনা দ্বারা কেবল মুসলিম দুনিয়া নয়, পূর্ব-পশ্চিমব্যাপী প্রচুর অমুসলিম চিন্তাবিদও প্রভাবিত হয়েছেন।

ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সভ্যতা, স্থাপত্য, কবিতা, আধুনিকতা, পরিবেশ, প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা বিশ্বব্যাপী জ্ঞান-তাত্ত্বিকদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর তরুণ চিন্তাবিদদের একজন শিক্ষক তিনি, এটাই তাঁর বড় পরিচয়।

১৯৩৩ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে একটি সম্ভ্রান্ত সূফী পরিবারে হোসাইন নাসেরের জন্ম। পিতা সাইয়্যেদ ভ্যালিআল্লাহ ছিলেন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ইরানের আধুনিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তেহরান শহরের একটি ইসলামী স্কুলে। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি চলে যান আমেরিকায়; সেখানে একটি স্কুলে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ইংরেজি, আরবি, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি আমেরিকার ইতিহাস, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। এ কারণেই বিশ্ববিখ্যাত এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে স্কলারশিপ প্রদান করে।maxresdefault (1).jpg

এমআইটিতে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পড়ার সময় তাঁর আগ্রহ জন্মে দর্শনে। তিনি বিশ্ববিখ্যাত সব দার্শনিকের বই পড়ে শেষ করেন। ফলে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে তাঁর মনে হাজারো প্রশ্ন জাগে। এমআইটিতে সকল বড় বড় বিজ্ঞানীকে তিনি এসব প্রশ্ন করেন। তারা কেউই তাঁকে সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে না পারায় তিনি পদার্থবিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। যদিও তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের সেরা ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এরপর তিনি ইচ্ছে করলেন প্রকৃতি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করার। ভূতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই তিনি হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।

তরুণ বয়সে হোসাইন নাসের যেসব দার্শনিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, সেসব সমাধান তিনি খুঁজে পাননি আধুনিক বিজ্ঞানে কিংবা পশ্চিমা দর্শনে। তাই তিনি গভীরভাবে পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন করেন, এবং কোরআনেই তাঁর সকল সমাধান খুঁজে পান। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘ইসলামে বিজ্ঞান ও সভ্যতা’। এ পর্যন্ত তাঁর পঞ্চাশটিরও অধিক ইসলামী বই এবং পাঁচ শতাধিক ইসলামী প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিভাগে তাঁর বই ও প্রবন্ধ সিলেবাসভুক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সব ভাষাতেই তাঁর লেখা বই ও প্রবন্ধ অনূদিত হয়েছে। ইন্টারনেটে তাঁর অসংখ্য অডিও এবং ভিডিও লেকচার রয়েছে।

ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের বিশ্বকোষগুলোতে বড় ধরনের একজন স্কলার হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর অবদান উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বের প্রথম মুসলিম ও নন-পশ্চিমা স্কলার হিসেবে তিনি বিশ্বখ্যাত গিফোর্ড লেকচারসের জন্য আমন্ত্রিত হন। এ ছাড়াও বিশ্বের অসংখ্য সম্মাননা তিনি গ্রহণ করেছেন।

সম্প্রতি তিনি ‘The Study Quran : A New Translation and Commentary’ নামে পবিত্র কোরআনের একটি ইংরেজি অনুবাদ ও টীকাভাষ্য সম্পাদনা করেছেন। তাঁর এই বইটি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে। তিনি ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সভ্যতা, স্থাপত্য, কবিতা, আধুনিকতা, পরিবেশ, প্রকৃতি সব কিছুর মধ্যেই ইসলামের মূল প্রস্তাবনা তাওহীদ বা আল্লাহ এক, এই বিষয়টি খুঁজে পেয়েছেন।

[লেখাটি ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো।]

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্