সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নবী ও রাসূলের মাঝে পার্থক্য কি?

অনেকে মনে করেন, যাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, তাঁরা হলেন রাসূল; এবং যাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়নি, তাঁরা হলেন নবী।

আসলে এ কথাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়। কারণ, যাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়নি, কোর’আনে তাদেরকেও রাসূল বলা হয়েছে। যেমন, ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِسْمَاعِيلَ ۚ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَّبِيًّا

“এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা বর্ণনা করুন। তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রসূল ও নবী।” [সূরা ১৯/ মারইয়াম – ৫৪]

আল্লাহ তায়ালা নবী ও রাসূল উভয়ের নিকট ওহী প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু পার্থক্য হলো, ওহীপ্রাপ্ত কোনো মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে যখন আল্লাহ কিছু বলেন, তখন তাঁকে নবী হিসাবে সম্বোধন করেন। আর যখন ওহীপ্রাপ্ত কোনো মানুষের দায়িত্ব নিয়ে আল্লাহ তায়ালা কোনো কথা বলেন, তখন তাঁকে রাসূল হিসাবে সম্বোধন করেন।

যেমন, মুহাম্মদ (স) একজন নবী ও রাসূল। নবী মুহাম্মদ (স) ও রাসূল মুহাম্মদ (স) এর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। ‘নবী’ মুহাম্মদ (স)-এর অনুসরণ করতে আমাদেরকে বলা হয়নি, বরং ‘রাসূল’ মুহাম্মদ (স)-এর অনুসরণ করার জন্যে আমাদেরকে বলা হয়েছে। এমনকি নবী মুহাম্মদ (স) স্বয়ং রাসূল মুহাম্মদ (স)-কে অনুসরণ করেন।

নিচের আয়াতগুলো দেখলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে।

নবী সম্বোধন করে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَحْلَلْنَا لَكَ أَزْوَاجَكَ اللَّاتِي آتَيْتَ أُجُورَهُنَّ وَمَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ مِمَّا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَيْكَ وَبَنَاتِ عَمِّكَ وَبَنَاتِ عَمَّاتِكَ وَبَنَاتِ خَالِكَ وَبَنَاتِ خَالَاتِكَ اللَّاتِي هَاجَرْنَ مَعَكَ وَامْرَأَةً مُّؤْمِنَةً إِن وَهَبَتْ نَفْسَهَا لِلنَّبِيِّ إِنْ أَرَادَ النَّبِيُّ أَن يَسْتَنكِحَهَا خَالِصَةً لَّكَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۗ قَدْ عَلِمْنَا مَا فَرَضْنَا عَلَيْهِمْ فِي أَزْوَاجِهِمْ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ لِكَيْلَا يَكُونَ عَلَيْكَ حَرَجٌ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا [٣٣:٥٠]

“হে নবী! আপনার জন্য হালাল করেছি সেসব স্ত্রীগণকে, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেছেন। আর হালাল করেছি তাদেরকে, যারা যুদ্ধেপ্রাপ্ত ফায় হিসাবে আপনার মালিকানাধীন। এবং বিবাহের জন্য হালাল করেছি আপনার চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, মামাতো বোন, খালাতো বোনকে, যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পণ করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা শুধুমাত্র আপনার-ই জন্যে, অন্য মুমিনদের জন্য নয়। মুমিনগণের স্ত্রী ও মালিকানাধীন নারীদের ব্যাপারে আমি যা নির্ধারিত করেছি, তা আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।” [সূরা ৩৩/আহজাব – ৫০]

এরপর, রাসূল সম্বোধন করে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ۖ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ ۚ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ

“হে রসূল, আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।”[সূরা ৫/ মায়িদা – ৬৭]

রাসূল শব্দটিকে নিয়ে আরো দুটি আয়াত দেখুন –

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا

“রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর; এবং তিনি তোমাদেরকে যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক।” [সূরা ৫৯/ হাশর - ৭]

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنكُمْ

“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং তাঁর রাসূল ও তোমাদের দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করো।” [সূরা ৪/ নিসা – ৫৯]

____________

উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট যে, যখন মুহাম্মদ (স)-কে একজন ব্যক্তি হিসাবে সম্বোধন করা হয়, তখন তাঁর জন্যে নবী শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু যখন মুহাম্মদ (স)-কে মানবজাতির দায়িত্বশীল হিসাবে সম্বোধন করা হয়, তখন তাঁর জন্যে রাসূল শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

নবী মুহাম্মদ (স) হিসাবে তিনি যে অনেকগুলো বিয়ে করেছেন, তা মুমিনদের জন্যে অনুকরণীয় নয়। কিন্তু রাসূল মুহাম্মদ (স) হিসাবে তিনি যা যা বলেছেন এবং যা যা করেছেন, সবকিছুই মুমিনদের জন্যে অনুকরণীয়। এটাই নবী ও রাসূলের মাঝে পার্থক্য।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...