সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদম (আ)-এর গল্পের শিক্ষা কি?

কোর’আনের প্রতিটি ঘটনাই আমাদের জন্যে শিক্ষণীয়। কেবল নবী রাসুলদের ইতিহাস জানানোর জন্যে আল্লাহ তায়ালা কোর’আনে বিভিন্ন কাহিনী দিয়ে ভরে রাখেননি, বরং প্রতিটি কাহিনীর পিছনে আমাদের জন্যে অসংখ্য শিক্ষা রয়েছে।

যেমন,

আদম (আ)-কে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেয়ার ঘটনাকে আমরা একটি ঐতিহাসিক তথ্য আকারে গ্রহণ করি। অথবা, মূসা (আ)-এর নদী পার হয়ে যাবার ঘটনাকে আমরা একটি অলৌকিক মুজিযা আকারে গ্রহণ করি। কিন্তু এসব ঘটনা কেবল ঐতিহাসিক কোনও তথ্য দেয়ার জন্যে, অথবা কোনও নবীর মুজিযা প্রকাশ করার জন্যে বর্ণনা করা হয়নি। বরং আমাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্যেই এসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ আদম (আ)-এর কাহিনীটি কল্পনা করা যাক,

কোর’আনে আদম (আ)-কে জান্নাত থেকে নামিয়ে দেয়ার কাহিনীটি যখন বর্ণনা করা হয়, তখন আমরা ভাবতে থাকি, এটি আদম (আ)-এর কাহিনী, সুতরাং এই ঘটনাটি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার তেমন কিছু নেই। অথচ আদম এর ঘটনাটি আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রতিদিন ঘটে থাকে।

দেখুন, আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের সব গাছ থেকেই খাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু কেবল একটি গাছ থেকে খেতে নিষেধ করেছিলেন। তেমনি, আমাদেরকেও আল্লাহ তায়ালা সবকিছু খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন, কিন্তু সুদ খেতে নিষেধ করেছেন।

এরপর,

আদম (আ)-এর কাছে শয়তান এসে বললো –

يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَّا يَبْلَىٰ
“হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দিব অনন্তকাল জীবিত রাখবে এমন বৃক্ষের কথা এবং অবিনশ্বর ক্ষমতার কথা? [সূরা ২০ / তা-হা – ১২০]

আদম (আ) অনন্ত জীবন লাভের আশায় শয়তানের এ কুমন্ত্রণাটি গ্রহণ করলেন। এর ফলে আদম (আ) জান্নাতে যে সুখ ও শান্তি ভোগ করছিলেন, তাঁর থেকে তা কেড়ে নেয়া হলো।

একইভাবে, শয়তান এসে আমাদের মনে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলে যে, “হে সুমন সাহেব! আমি কি আপনাকে একটা সুন্দর পদ্ধতি শিখিয়ে দিব? আপনি ব্যাংকে কিছু টাকা জমা রাখলে আজীবন কোনও চিন্তা এবং পরিশ্রম করা ছাড়াই খেয়ে যেতে পারবেন। আপনি মারা গেলে আপনার সন্তান, তারা মারা গেলে তাদের সন্তানও এভাবে বিনা পরিশ্রমে সারা জীবন খেয়ে যেতে পারবে। সুতরাং, আপনি ব্যাংকে কিছু টাকা জমা রাখুন, এবং এর বিপরীতে আমরা আপনাকে প্রতি মাসে মাসে যে টাকা 'ইন্টারেস্ট' হিসাবে দিব, তা দিয়ে আপনি ও আপনার বংশধর সবাই নিশ্চিন্তে খেয়ে যেতে পারবেন”।

অন্যদিকে, আরেক শ্রেণীকে শয়তান এসে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলে যে, “দেখো, তুমি এখন যে অবস্থায় আছো, তা থেকে আরো বেশি উন্নত এবং সমাজে আরো বেশি সম্মানিত হবার জন্যে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অথবা অন্য কোনও ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ঋণ নাও, মাসে মাসে ব্যাংকে অল্প কিছু টাকা শোধ করে দিতে পারলেই তুমি বিশাল ব্যবসা ও সম্মানের মালিক হয়ে যাবে। সুতরাং, ধরো, যা ইচ্ছে ঋণ নাও”।

আদম (আ)-কে শয়তান যেভাবে লোভ দেখিয়েছে, ঠিক একইভাবে আমাদেরকেও শয়তান লোভ দেখিয়ে ইন্টারেস্ট বা সুদ খাওয়ার জন্যে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। এবং আমরা আদম (আ)-এর মতো ভুল করেই সেই কুমন্ত্রণাটি গ্রহণ করে ফেলি।

শয়তান আমাদেরকে বুঝিয়ে বলে যে, অল্প একটু ইন্টারেস্ট বা সুদ খেলে পৃথিবীতে সারাজীবন খুবই সুখে ও শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু, আমরা যখন নিজে সুদ খাই অথবা অন্যকে সুদ দেই, তখন আল্লাহ তায়ালা আমাদের হৃদয় থেকে প্রশান্তি কেড়ে নিয়ে যান, যেমন, আদম (আ) থেকে জান্নাতটি কেড়ে নেয়া হয়েছিলো।

এরপর,

আদম (আ)-এর মতো আমরা যখন আমাদের ভুল বুঝতে পারি, এবং ইন্টারেস্ট থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারি, তখন আল্লাহ তায়ালা আবার আমাদেরকে প্রকৃত সুখ ও শান্তি ফিরিয়ে দেন।

অনেকেই আছেন, যারা ইন্টারেস্ট বা সুদের আদান-প্রদান করেন না, তাহলে আদম (আ)-এর এ গল্পটি তাঁদের জীবনে কিভাবে কাজে লাগবে?

আপনার কোনও সন্তান বা ভাই-বোন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী হয়ে থাকলে, তার গণিত বইটি খুলুন। দেখবেন, সেখানে ইন্টারেস্টের অনেক ফর্মুলা বা সূত্র রয়েছে। এগুলো পড়ানোর সময় তাদেরকে আদম (আ) এর গল্পটি মনে করিয়ে দিতে পারেন, এবং শয়তানের কুমন্ত্রণাটিও বুঝিয়ে দিতে পারেন। একইসাথে বুঝিয়ে দিতে পারেন যে, আমাদের পাঠ্যপুস্তক কিভাবে আমাদেরকে কোর’আনের শিক্ষা থেকে দূরে নিয়ে যায়, এবং কিভাবে সুদ খাওয়ার কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে।

জেনে বা অজান্তে, যখনি আমরা সুদের সাথে সম্পর্কিত হয়ে যাবো, তখনি আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু যাবে। আল্লাহ তায়ালা কোর’আনে বলছেন –

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ - فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَإِن تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। আর, যদি তোমরা সুদ পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না। [সূরা ২/বাকারা - ২৭৮]”

আধুনিক যুগে যারা প্রকৃত অর্থেই জিহাদ করতে চায়, তাঁদের কাজ হলো প্রথমত নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সুদমুক্ত রাখা। এবং দ্বিতীয়ত, সকল মানুষকে সুদের বিরুদ্ধে সচেতন করা।
____________

তো, শুরুতে যা বলছিলাম, কোর'আনের গল্পগুলোকে আমাদের দৈনন্দিন সমস্যার সাথে মিলিয়ে বুঝতে পারলে দুটি কাজ হবে।

১। কোর’আনের গল্পগুলোকে কেবল একটি ঐতিহাসিক তথ্য বা অপ্রয়োজনীয় গল্প মনে হবে না।

২। পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের চারপাশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান আমরা কোর'আনের কাহিনীগুলো থেকে বের করতে পারবো।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...