সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

যার কাছে ধর্ম পৌঁছায়নি, তিনি কি জাহান্নামে যাবেন?

কেউ যদি অ্যামাজন জঙ্গলে বাস করে, অথবা, কোনো মানুষের নিকট যদি পৃথিবীর কোনো ধর্ম বা শিক্ষা না পৌঁছে, তাহলে সে কি জাহান্নামে যাবে?

একজন ভাইয়া ইনবক্সে আমাকে এ প্রশ্নটি করেছেন।

এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে একটু নজর দেই। বাংলাদেশে যখন S.S.C. পরীক্ষা শুরু হয়, তখন সারা দেশের সকল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা একই দিনে এবং একই সময়ে শুরু হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, বা যে কোনো বোর্ডের প্রশ্নপত্রগুলো সব একই রকম হয়। অর্থাৎ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করার জন্যে একটিমাত্র প্রশ্নপত্র দেয়া হয়।

কিন্তু, আল্লাহ তায়ালা মানুষদের থেকে এভাবে পরীক্ষা নেন না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের যোগ্যতা ও সমর্থ অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন প্রস্তুত করেন। অর্থাৎ, বাংলাদেশী একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে প্রশ্ন করবেন, অ্যামাজন জঙ্গলে বসবাসকারী একজন মানুষকে আল্লাহ তায়ালা ঠিক সেভাবে প্রশ্ন করবেন না।

কোর’আনে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا

“আল্লাহ কোনো মানুষকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজের ভার দেন না”। [সূরা ২/ বাকারা - ২৮৬]

অর্থাৎ, একজন বাংলাদেশি হিসাবে আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা যে দায়িত্ব দিয়েছেন, একজন জঙ্গলে বসবাস কারীর সে দায়িত্ব নেই।

উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের ইবাদতগুলোর প্রতি লক্ষ করুন। যাকাত দেয়া সকল মানুষের জন্যে ফরজ নয়, যাদের টাকা-পয়সা আছে, কেবল তাদের যাকাত দিতে হয়, গরিব মানুষদেরকে যাকাত দিতে হয় না। অর্থাৎ, যাকাত দেয়া সব মুসলিমের জন্যে সব সময় ফরজ নয়।

একইভাবে, হজ্জ করাও প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে ফরজ নয়। যাদের আর্থিক ও শারীরিক সমর্থ আছে, কেবল তাদের জন্যে হজ্জ করা ফরজ। গরিব ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যে হজ্জ করা ফরজ নয়।

একই কথা নামাজ ও রোজার ক্ষেত্রে। পুরুষদের জন্যে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং রমজানের ৩০টি রোজা ফরজ হলেও নারীদের জন্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ পড়া ও রোজা রাখা ফরজ নয়।

একইভাবে, একজন মুসলিম যখন নিজের বাসা বা বাড়িতে থাকে তখন তাকে পূর্ণ নামাজ পড়তে হয়, এবং রমজানের রোজা রাখতে হয়। কিন্তু ঐ মানুষটি যখন ভ্রমণে বের হয়, তখন তাকে অর্ধেক নামাজ বা কসর পড়তে হয় এবং তাকে রমজানের রোজা রাখতে হয় না।

অর্থাৎ, ব্যক্তি, সমর্থ, সময় ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ইবাদতগুলো পরিবর্তিত হয়। যার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে, তাঁকে আল্লাহ তায়ালা যা জিজ্ঞাস করবেন, যার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি, তাঁকেও আল্লাহ তায়ালা সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন না।

কোর’আনে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

مَّنِ اهْتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَهْتَدِي لِنَفْسِهِ ۖ وَمَن ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا ۚ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ ۗ وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّىٰ نَبْعَثَ رَسُولًا

“যে কেউ সৎপথ অবলম্বন করে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎপথ অবলম্বন করে। আর, যারা পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না”। [সূরা ১৭/ বনী ঈসারাঈল - ১৫]

এ আয়াতের শেষের বাক্যটি দ্বারা স্পষ্ট যে, জঙ্গলের মতো কোনো স্থানে অথবা কারো নিকট যদি ইসলামের দাওয়াত না পৌঁছায়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শাস্তি দিবেন না।

এবার এ প্রসঙ্গে অন্য একটি ব্যাখ্যায় যাচ্ছি।

যেসব মানুষকে আল্লাহ তায়ালা জঙ্গলে সৃষ্টি করেছেন, সেটা ঐ মানুষদের দোষ নয়। সুতরাং, সে মানুষদেরকে সত্য পথে পরিচালনা করার দায়িত্বও আল্লাহ তায়ালার।

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে আকল বা বুদ্ধি দান করেছেন, যা দিয়ে মানুষ আল্লাহকে চিনতে পারে। কোনো স্থানে যদি কোনো নবী বা রাসূল নাও পাঠানো হয়, তবুও মানুষ তার বুদ্ধির দ্বারা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করতে পারে।

একজন মানুষ নামাজ না পড়ুক, রোজা না রাখুক, হজ্জ না করুক, কেবল আকল বা বুদ্ধির নির্দেশনা অনুযায়ী যদি সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করে, এবং মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে, তাহলে তিনি ধীরে ধীরে মহাসত্যের সন্ধান পাবেন। যেমনটা পেয়েছিলেন সালমান আল ফারসী (রা)। তিনি নিজের আকলকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে প্রথমে বিভিন্ন ধর্মে ধর্মান্তরিত হন, এবং সর্বশেষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

সুতরাং, জঙ্গলের কোনো মানুষের কাছে কোনো নবী বা রাসুল না পৌঁছালেও তিনি যদি নিজের কাছে নিজে সৎ থাকতে পারেন এবং আকলের সঠিক ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে তিনিও মহাসত্যের সন্ধান পেতে পারেন।

আল্লাহ তায়ালার একটি নাম হলো হক বা মহাসত্য। নিজের বিবেকের কারণে যিনি সত্যকে সত্য মনে করে চলেন, এবং মিথ্যাকে ভ্রান্ত মনে করেন, তিনি মহাসত্যের সন্ধান লাভ করতে পারেন, এবং আল্লাহর উপলব্ধি করতে পারেন। আল্লাহকে উপলব্ধি করাটা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম।

একজন মানুষ জীবনে তিনি যতটুকু সত্য উপলব্ধি করতে পারেন, ততটুকু সত্যকে মেনে নেয়াই তাঁর দায়িত্ব। যে সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে পারে না, সে সত্য মানতে না পারার কারণে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হবে না। জঙ্গলে বসবাসকারী একজন ব্যক্তিকে যতটুকু সত্য উপলব্ধি করার তৌফিক আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দিয়েছেন, ততটুকু সত্যকে মেনে চলার জন্যেই তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...