সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইলম ও আমলের সম্পর্ক

কোনো আলেম কি নাস্তিক হতে পারে?

উত্তর – না।

কেন?

কারণ, আলেম বলা হয়, যিনি ইলমের অনুসারী তাঁকে।।

প্রশ্ন হলো, ‘ইলম’ কি?

ইলম [علم] শব্দের অর্থ করা হয় knowledge বা জ্ঞান। কিন্তু, নলেজ বা জ্ঞানের সাথে ‘ইলম’ শব্দটির অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে।

আমাদের উপমহাদেশে তথ্য মুখস্থ করাকে বলা হয় জ্ঞান। যিনি যত বেশি তথ্য মুখস্থ করতে পারেন, তিনি ততবড় জ্ঞানী উপাধিতে ভূষিত হন। এবং চাকরির ক্ষেত্রেও মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী তোতাপাখীগন অন্যদের চেয়ে বেশি সফল হতে পারেন। “থ্রি ইডিয়টস” মুভিতে বিষয়টি ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছিল।

নলেজ বা জ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের উপমহাদেশের চেয়ে একটু ভালো। কিন্তু তাঁদের সমস্যা হলো, তাঁরাও মনে করেন, জ্ঞান মানে তথ্য। এ কারণে, ইংরেজি কবি T.S. Eliot দুঃখ করে বলেন –Where is the knowledge we have lost in information?

অর্থাৎ, পশ্চিমা বিশ্বেও সত্যিকার জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তথ্যকেই জ্ঞান মনে করা হয়।

এবার দেখি, ইসলামে জ্ঞান কি?

জ্ঞানের জন্যে কোর’আনে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো ইলম [علم]। এখানে তিনটি অক্ষর রয়েছে – [ع- ل - م]। এ তিনটি অক্ষর দিয়ে আরেকটি শব্দ গঠিত হয়, আমল [عمل]। আরবি আমল শব্দের অর্থ হলো কাজ বা প্রয়োগ। অর্থাৎ, ইলম ও আমল একই অক্ষর দ্বারা গঠিত।

ইসলামে ‘জ্ঞান’ ও ‘কাজ’ দুটি বিষয় পরস্পর দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। কেবল জ্ঞানের জন্যে জ্ঞান, (knowledge for sake of knowledge) অথবা শিল্পের জন্যে শিল্প (art for art's sake) – এই ধারণাগুলো ইসলামে নেই।

ইসলামের প্রতিটি জ্ঞান যেমন কাজের সাথে যুক্ত, তেমনি প্রতিটি কাজ জ্ঞানের সাথে যুক্ত। যে জ্ঞান ব্যক্তিগত ও সামাজিক কল্যাণে প্রয়োগ করা যায় না, ইসলাম তাকে জ্ঞান হিসাবে স্বীকার করে না। কোর’আনে যত স্থানে ইমানের কথা বলা হয়েছে, সকল স্থানে আমল বা কাজের উল্লেখ করা হয়েছে।

কেউ কোনো বই, কিতাব বা অনেক তথ্য মুখস্থ করে ফেললেই ইসলাম তাকে জ্ঞানী বলে না। বরং, কেউ তাঁর জ্ঞানের যতটুকু ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারেন, তিনি ততটুকু আলেম বা জ্ঞানী হতে পারেন।

এ কারণেই, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞাস করবেন না যে, কে কত তথ্য মুখস্থ করতে পেরেছিল। বরং তিনি প্রশ্ন করবেন, কে কত ভালো কাজ করতে পেরেছিল।

এবার আসি, মূল প্রসঙ্গে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম, একজন ‘হাফেজ আলেম মুফতি’ নাকি নাস্তিক হয়ে গেছে।

আমাদের সমাজে আমরা এখনো মনে করি, কেউ পাঞ্জাবি-টুপি পরে দাঁড়ি রাখলেই সে বড় আলেম ও মুফতি। অথবা, কেউ কোর’আন মুখস্থ করলেই আমরা তাঁকে বড় আলেমের আসনে বসিয়ে দেই। এটা আমাদের সাধারণ মানুষের সমস্যা। আমরা পোশাকের কারণে মানুষকে আলেম বলি, আবার, পোশাকের কারণেই মানুষকে জাহেল বলি।

অথচ, পোশাকের সাথে জ্ঞানের নূন্যতম কোনো সম্পর্ক নেই।

আল্লাহর কিতাব মুখস্থ করে হাফেজ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কেউ নাস্তিক হয়ে যাবার ঘটনা কেবল এখন না, অনেক আগ থেকেই ছিল। ইহুদীদের অনেকেই তাওরাত মুখস্থ করতো, আবার, আল্লাহর আয়াত সমূহকে মিথ্যা বলতো। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

مَثَلُ ٱلَّذِينَ حُمِّلُوا۟ ٱلتَّوْرَىٰةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ ٱلْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًۢا ۚ بِئْسَ مَثَلُ ٱلْقَوْمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِ ٱللَّهِ ۚ وَٱللَّهُ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلظَّـٰلِمِينَ

“যাদেরকে তওরাতের দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা তা যথাযথভাবে বহন করেনি। তাদের উদাহরণ সেই গাধার মত, যে পুস্তক বহন করে। কত নিকৃষ্ট তাদের উদাহরণ, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে। আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না”।

জনৈক যে ব্যক্তিটি নিজেকে হাফেজ, আলেম ও মুফতি দাবী করে আল্লাহর কিতাবের বিরোধিতা করছেন, তার উদাহরণ এই আয়াতের গাধাটির মত।

আর, গাধাদেরকে জ্ঞানী বা আলিম বলা হয় না।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্