সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের কথা একটু কল্পনা করুন। আপনার চোখে কি ভেসে উঠবে?

ভয়ঙ্কর সব চিত্র।

ছোট বেলার আরবি শিক্ষক মানেই বেত্রাঘাত। পড়া না পারলেই ঠাস... ঠাস...। এরপর, প্রাইমারি স্কুলের অংক শিক্ষক। ভুল করলেই ডাস্টার নিক্ষেপ, এবং মাথা পেটে রক্ত। তারপর, হাই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। প্রাইভেট না পড়লে নিশ্চিত ফেল। অতঃপর, মাদ্রাসার হুজুর। প্রশ্ন করলেই বলেন – “বেয়াদব কোথাকার”। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো নিজদেরকে ‘প্রভু’ মনে করেন। সামান্য একটা প্রশ্নের কারণে ১৫/১৬ বছরের ছাত্রজীবনকে একেবারে ধ্বংস করে দেন।

কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষকদের কোচিং ও প্রাইভেট ব্যবসা জমজমাট। অর্থের বিনিময় ছাড়া শিক্ষা প্রদান করতে তাঁরা মোটেও আগ্রহী নন।

এই হলো আমাদের শিক্ষক সম্প্রদায় এবং এই হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।

শিক্ষাব্যবস্থার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম, এটা পরিবর্তন করা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু একজন শিক্ষক তো নিজেকে ভালো ব্যবহারের অধিকারী করতে পারেন। এতে তো কোনো বাধা নেই। তবু আমাদের শিক্ষক সমাজের আজ এই অবস্থা কেন?

ইতিহাসে দেখি। আহ! কত সুন্দর ছিল আমাদের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। কত উত্তম ছিলেন আমাদের শিক্ষকগণ।

মুহাম্মদ (স) ছিলেন বিশ্বমানবতার শিক্ষক। ছাত্রদের প্রতি তাঁর প্রেম, ভালোবাসা ও দয়া ছিল অপরিসীম। তাঁর উত্তম চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়ে আল্লাহ বলেন –

وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍۢ

“আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী”। [সূরা ৬৮ / কালাম - ৪]

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হয়েও রাসূল (স) কখনো কাউকে ছাত্র হিসাবে সম্বোধন করেননি। তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন – ‘তোমরা আমার সাহাবী বা সঙ্গী-সাথী’। বন্ধুর মতই রাসূল (স) তাঁর ছাত্রদের সাথে আচরণ করতেন।

আপনি হয়তো বলবেন, ‘তিনি তো রাসূল’। আচ্ছা, তাঁর কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। কিন্তু আমাদের ইসলামের ইতিহাসে দেখুন। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক কতই না মধুর ছিল!
_______

ইমাম আবু হানিফা তাঁর ছাত্রদেরকে স্কলারশিপ দিয়ে নিজের মাদ্রাসায় পড়াতেন। নিজে স্কলারশিপ দিয়ে ছাত্র পড়াতেন বলে কখনোই ছাত্রদের সাথে প্রভুর মত আচরণ করতেন না। আচরণ করতেন বন্ধুর মত।

যে কোনো বিষয়ে পাঠ দান করার আগে ইমাম আবু হানিফা এসে বলতেন – “দেখ, এই সমস্যাটির সমাধান তোমরা কিভাবে করবে?”

ছাত্ররা তাঁদের নিজ নিজ মত প্রদান করতেন, এবং সবশেষে আবু হানিফা তাঁর মত প্রকাশ করতেন। কিন্তু নিজের মত ছাত্রদের উপর কখনো চাপিয়ে দিতেন না।

কখনো কখনো ছাত্র আবু ইউছুফ, মুহাম্মদ বা অন্য কেউ বলতেন, “উস্তাদ, আমি আপনার মতটি মেনে নিতে পারলাম না”। আবু হানিফা তখন বলতেন, “সমস্যা নেই, তোমার ভিন্ন মতটিও আমার মতের সাথে লিপিবদ্ধ করা হবে”।

আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন এমনি। ছাত্রদের কথা আগে শুনতেন, এবং ছাত্রদের মতকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে নিজ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন।
_______

ইমাম আবু মানসুরের নাম ডাক নাম ছিল ‘মাতুরিদি’। কেন তাঁকে মাতুরিদি বলা হত, জানেন? কারণ, তিনি তাঁর শিক্ষকদেরকে প্রচুর প্রশ্ন করতেন। তাঁর শিক্ষকরা তাঁকে বলতেন – “মা তুরিদ’ [ما تريد]। মানে, তুমি কি বলতে চাও, বল।

শিক্ষকরা তাঁকে এত বেশি “মা তুরিদ” বলতেন যে, তাঁর বন্ধুরা তাঁর নাম দিয়ে দিয়েছেন – ‘মাতুরিদি’।

ইসলামের সোনালী যুগে শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে প্রচুর কথা বলার সময় দিতেন। ছাত্রদেরকে তাঁদের ভিন্ন চিন্তা উপস্থাপনের সুযোগ দিতেন। ছাত্রদের সাথে তাঁরা বন্ধুর মত আচরণ করতেন।
_______

আপনি হয়তো বলতে পারেন – ‘আগের কাল বাঘে খেয়েছে। এখনকার যুগের ছাত্ররা খারাপ, তাই শিক্ষকদেরকে খারাপ আচরণ করতে হয়’।

ভুল।

উন্নত বিশ্বের শিক্ষকদের দেখুন। তাঁরা বাংলাদেশী শিক্ষকদের মত ছাত্রদের সাথে খারাপ ও প্রভুর মত আচরণ করেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমাদের চেয়ারম্যান আমাদেরকে চেয়ার দিয়ে মেরেছিলেন। এর চেয়ে অসভ্য আচরণ আর কি হতে পারে?

তুরস্কে দেখেছি, শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে ‘আরকাদাশলার’ বা ‘বন্ধুরা’ ছাড়া কখনো সম্বোধন করেন না। ছাত্ররা শিক্ষকদের সাথে কথা বললে তাঁরা যার পর নাই খুশী হন। স্যারদের রুমে গেলে তাঁরা নিজের টাকা দিয়ে ছাত্রদেরকে চা-চকলেট খাওয়ান।

সুতরাং,

বর্তমান সময়ে সমস্যা আমাদের শিক্ষার্থী নয়, বরং সমস্যা শিক্ষকদের। আমি বলছি না, বাংলাদেশের সকল শিক্ষক খারাপ, কিন্তু ১৮ বছরের ছাত্রজীবনে দেখেছি, অধিকাংশ শিক্ষক-ই ছাত্রদের সাথে খারাপ আচরণ করেন। ছাত্ররা শিক্ষকদেরকে এমনভাবে স্যার, স্যার বা হুজুর, হুজুর করতে হয় যে, দেখে মনে হয়, শিক্ষকরা হলেন ছাত্রদের প্রভু।

শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রভু নন, শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের বন্ধু বা সাহাবী হওয়া।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রাসূল (স)-এর মত আদর্শ শিক্ষক হবার তৌফিক দান করুক।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্