সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বক্ষ প্রশস্ত হওয়ার বিজ্ঞান

ছোট বেলায়, টেবিলে পড়তে বসে শুরুতে একটি দোয়া না পড়লে আব্বু-আম্মু বকা দিতেন। দোয়াটা হলো –

رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي يَفْقَهُوا قَوْلِي

অর্থাৎ,

“হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। আমার কাজ সহজ করে দিন। এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।” [আল কোর’আন, ২০/সূরা তাহা, আয়াত ২৫-২৮]

মূলত, এ দোয়াটি হজরত মূসা (আ)-এর একটি দোয়া। মূসা (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা যখন ফিরাউনের নিকট যাওয়ার আদেশ দিলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে এই দোয়াটি করেছিলেন।

তো, ছোট থেকে যখন আমি আরেকটু বড় হলাম, এবং যখন এই দোয়াটির অর্থ বুঝলাম, তখন মনে একটি প্রশ্ন আসলো – ‘আচ্ছা, বক্ষ প্রশস্ত হওয়ার সাথে পড়াশুনার সম্পর্ক কি?”

এরপর, বয়স যখন আরেকটু বাড়ল, তখন নতুন করে আরেকটি প্রশ্ন মনে উদয় হলো – “আচ্ছা, মূসা (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমতাশীল ফিরাউনের নিকট পাঠাতে চাইলেন, কিন্তু মূসা (আ) আল্লাহর নিকট একদল সেনাবাহিনী বা কোনো শক্তি কামনা না করে, তাঁর বক্ষ প্রশস্ত করে দেয়ার জন্যে দোয়া করলেন কেন?

এ প্রশ্ন দুটির উত্তর আমি যেভাবে বুঝেছি, তা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

প্রথমে একটা ছোট্ট ভূমিকা দিয়ে রাখি। বিভিন্ন জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীরা বলেন, আল্লাহ তায়ালার মৌলিক সৃষ্টি চারটি।

১ – বস্তু। যেমন, মানুষ, মাটি, পানি, বায়ু, অক্সিজেন।
২ – শক্তি বা এনার্জি। যেমন, ফেরেশতা, জিন, আলো, আগুন, তাপ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ।
৩ – সময়। যেমন, সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড, গতি।
৪ – স্থান। দেশ, মহাদেশ, পৃথিবী, আসমান, বিগ ব্যাং, বিন্দু।

এ চারটি মৌলিক সৃষ্টি একটি অন্যটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন, বস্তু, শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে। আবার, শক্তি, বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে।

বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে, E=mc^2

এ কথা আলবার্ট আইনস্টাইন যখন তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানীদেরকে বললেন, বিজ্ঞানীরা সবাই তাঁর উপর চরম ক্ষেপে গেলেন। কেউ কেউ আইনস্টাইনকে পাগল-ছাগল বলে গালাগালি করতে লাগলেন। আবার, কেউ কেউ বলতে শুরু করলেন, ‘আইনস্টাইন তো বিজ্ঞানের ‘ব’-ও বুঝে না।’

যাই হোক, পরবর্তীতে সেকেলে বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করলো যে – ‘আইনস্টাইনের কথা আসলে ঠিক ছিল। বস্তুকে শক্তিতে পরিণত করা যায়। আবার শক্তিকে বস্তুতে পরিণত করা যায়।’ একইসাথে তারা এটাও বুঝতে শুরু করলো যে, সময়কে স্থানে পরিবর্তন করা যায়, আবার স্থানকে সময়ে পরিবর্তন করা যায়। আর, এ কারণে অবশেষে আইনস্টাইনকে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হলো।

উপরে, এই ছোট্ট ভূমিকাটি বলতে হয়েছে, কারণ, একটু পরে কেউ যেন আবার আইনস্টাইনের সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের মত আমাকে বলে না বসেন – ‘এই ছেলের তো সমস্যা আছে!!!’

জানি, আপনারা সেকেলে বিজ্ঞানীদের মত এত জাজমেন্টাল বা সমালোচক নন। তাই, উপরের দোয়াটি থেকে আমি যা বুঝেছি, এবার তা বলছি –

মানুষের হৃদয় তিন ভাবে প্রভাবিত হয়।

১। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কারণে। [সূত্র – আল কোর’আন ৩৯: ২৩, ৫: ১১৩, ৪৭: ১৬, ৩৩: ১০, ৯: ১২৭, ৬: ৪৬]

২। চারপাশের পরিবেশের কারণে। [সূত্র – আল কোর’আন ১১৪: ৫, ৩৩: ১০, ২: ৯৩, ৪১: ৫, ৩৯: ২২]

৩। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায়। [সূত্র – আল কোর’আন ২: ৯৭, ২৮: ১০, ৩৩: ২৬, ১৮: ১৪, ৮: ২]

আমাদের শরীরের চতুঃপার্শ্বে ও পরিবেশের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের এনার্জি থাকে। আমরা যখন নিশ্বাস গ্রহণ করি, তখন এনার্জিগুলো অক্সিজেনের সাথে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। আমাদের শ্বাসযন্ত্র বা ফুসফুস সেই এনার্জিগুলোকে রক্তের সাথে মিশিয়ে দেয়। ফলে কিছু এনার্জি আমাদের শারীরিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, এবং কিছু এনার্জি আমাদের চিন্তা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

ভালো মানুষদের আশেপাশে, কিংবা ভালো কোনো পরিবেশে আল্লাহ তায়ালার নূর বা ভালো এনার্জি থাকে। অন্যদিকে, খারাপ মানুষদের আশেপাশে, কিংবা খারাপ পরিবেশে শয়তান বা খারাপ এনার্জি থাকে। মানুষ ইচ্ছা করলে ভালো এনার্জি গ্রহণ করে মানসিক ও শারীরিকভাবে অনেক শক্তিশালী হতে পারে। অন্যদিকে, ভালো এনার্জি গ্রহণ না করলে, শয়তান মানুষের ফুসফুসে খারাপ এনার্জি প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ করে ফেলে।

কোর’আনে বিষয়টি খুবই সুন্দরভাবে আল্লাহ তায়ালা তুলে ধরেছেন –

أَفَمَن شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ فَهُوَ عَلَىٰ نُورٍ مِّن رَّبِّهِ فَوَيْلٌ لِّلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ

“আল্লাহ যার বক্ষ ইসলামের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, অতঃপর সে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত আলোর মাঝে রয়েছে। সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়? দুর্ভোগ, সেই কঠোর হৃদয়ের ব্যক্তিদের জন্যে, যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ। তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।” [সূরা ৩৯/যুমার – ২২]

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, যার শ্বাসযন্ত্রে বা ফুসফুসে যতবেশি ভালো এনার্জি প্রবেশ করে, তিনি ততবেশি শক্তিশালী চিন্তার মানুষ হন, তিনি ততবেশি আলোকিত হন, এবং তিনি ততবেশি ইসলামের পথে চলেন।

এ কারণেই, ফিরাউনের মোকাবেলা করতে যাবার আগে মূসা (আ) দোয়া করলেন –

رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي يَفْقَهُوا قَوْلِي

“হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন। আমার কাজ সহজ করে দিন। এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।”

এবং সম্ভবত এ কারণেই, আব্বু-আম্মু ছোটবেলায় পড়ালেখা শুরু করার আগে এই দোয়াটি পড়তে বলতেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...