সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আল কোর'আনের আলোকে মানুষের বৈশিষ্ট্য

আল কোর’আনে মানুষের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। এগুলোকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক – শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং দুই – চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো –

১. সুন্দর আকৃতি বিশিষ্ট।

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ

“আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।” [সূরা ৯৫/তীন – ৪]

২. দুর্বল প্রকৃতির। [সূত্র: সূরা ৪/নিসা - ২৮]

৩. শ্রম নির্ভর। [সূত্র: সূরা ৯০/বালাদ -৪]

আর, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো –

১. অকৃতজ্ঞ।

وَآتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ ۚ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ۗ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ

“যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ”। [সূরা ১৪/ইব্রাহীম – ৩৪]

[আরো দেখুন: সূরা ১০/ইউনুস – ১২; সূরা ১৭/বনী ইসরাইল – ৬৭; সূরা ৩৯/যুমার – ৪৯; সূরা ৪১/হা-মীম আস্‌-সাজদা – ৫১; সূরা ৪২/শূরা – ৪৮; সূরা ৪৩/যুখরুফ – ১৫; সূরা ৮০/আবাসা – ১৭; সূরা ৮৯/ফাজর – ১৬; সূরা ১০০/আদিয়াত – ৬ ]

২. আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসী।

وَيَقُولُ الْإِنْسَانُ أَإِذَا مَا مِتُّ لَسَوْفَ أُخْرَجُ حَيًّا

“মানুষ বলে: আমার মৃত্যু হলে পর আমি কি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হব?” [সূরা ১৯/মারইয়াম – ৬৬] [আরো দেখুন। সূরা ৩৯/যুমার – ৮; সূরা ৭৫/কিয়ামা – ৩ ]

৩. অজ্ঞ ও অহংকারী।

فَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَىٰ عِلْمٍ ۚ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

“মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি আমার জ্ঞানের কারণেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।” [সূরা ৩৯/যুমার – ৪৯] [আরো দেখুন: সূরা ৩৩/আহযাব – ৭২]

৪. বাকবিতাণ্ডাকারী ও তর্ক প্রিয়।

وَلَقَدْ صَرَّفْنَا فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ لِلنَّاسِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ ۚ وَكَانَ الْإِنْسَانُ أَكْثَرَ شَيْءٍ جَدَلًا

“নিশ্চয় আমি এ কোর'আনে মানুষকে নানাভাবে বিভিন্ন উপমার দ্বারা আমার বাণী বুঝিয়েছি। মানুষ অধিকাংশ ব্যাপারেই অধিক তর্কপ্রিয় ।” [সূরা ১৮/কাহ্‌ফ – ৫৪] [আরো দেখুন: সূরা ৩৬/ইয়াসীন – ৭৭]

৫. অস্থিরচিত্ত ও দ্রুততা প্রিয়।

وَيَدْعُ الْإِنْسَانُ بِالشَّرِّ دُعَاءَهُ بِالْخَيْرِ ۖ وَكَانَ الْإِنْسَانُ عَجُولًا

“মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততা প্রিয় ।” [সূরা ১৭/বনী ইসরাঈল – ১১] [আরো দেখুন: সূরা ৭০/মা’আরিজ – ১৯]

৬. হতাশ ।

وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنْسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَىٰ بِجَانِبِهِ ۖ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ كَانَ يَئُوسًا

“আমি মানুষকে নেয়ামত দান করলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারে দুরে সরে যায়; যখন তাকে কোন অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে। [সূরা ১৭/বনী ইসরাঈল – ৮৩] [আরো দেখুন: সূরা ১১/হূদ – ৯]

৭. কৃপণ।

قُلْ لَوْ أَنْتُمْ تَمْلِكُونَ خَزَائِنَ رَحْمَةِ رَبِّي إِذًا لَأَمْسَكْتُمْ خَشْيَةَ الْإِنْفَاقِ ۚ وَكَانَ الْإِنْسَانُ قَتُورًا

“বলুন: যদি আমার পালনকর্তার রহমতের ভাণ্ডারও তোমাদের হাতে থাকত, তবে খরচ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তোমরা অবশ্যই তা ধরে রাখতে। মানুষ তো অতিশয় কৃপণ ।” [সূরা ১৭/বনী ইসরাঈল – ১০০] [আরো দেখুন: সূরা ৭০/মা’আরিজ – ২১]

৮. অত্যাচারী। [সূত্র: সূরা ১৪/ইব্রাহীম – ৩৪]

৯. সীমালংঘন। [সূত্র: সূরা ৯৬/আলাক – ৬]

১০. বিভ্রান্ত। [সূত্র: সূরা ৮২/ইনফিতার – ৬]

এবার কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করুন।

এক.
আল্লাহ তায়ালা মানুষের শারীরিক যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা কোর’আনে উল্লেখ করেছেন, সবগুলো ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু মানুষের চারিত্রিক যতগুলো বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, সবগুলো নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেছেন।

কারণ, শারীরিকভাবে মানুষ সুন্দর ও দুর্বল হওয়ার পিছনে তার নিজের কোনো হাত নেই। কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষ নিজে নিজে অর্জন করে। তাই কোর’আনে মানুষের শারীরিক এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে ইতিবাচক অর্থে এবং চারিত্রিক এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

সুতরাং, মানুষের শারীরিক সৌন্দর্যের কারণে যেমন অহংকার করা উচিত নয়, তেমনি শারীরিক দুর্বলতার কারণেও হতাশ হওয়া উচিত নয়। কারণ, চরিত্রগত অর্জন-ই হলো মানুষের আসল যোগ্যতা।

দুই.
আল্লাহ তায়ালা মানুষের যে চরিত্রের কারণে তাকে সবচেয়ে বেশি নিন্দা করেছেন, তা হলো ‘অকৃতজ্ঞতা’। এ কারণেই কোর’আনের শুরুতে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার মাধ্যমে মানুষকে সর্বপ্রথম কৃতজ্ঞ হবার শিক্ষা দিয়েছেন।

তিন.
মানুষের চারিত্রিক এই মন্দ বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে মুক্তির উপায় হলো সৎকাজ বা আমলে সালেহ করা। আর ‘আমলে সালেহ’ হলো সেই কাজ – যা দ্বারা কেবল নিজে নয়, অন্য মানুষেরও উপকার সাধন করা হয়। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা সূরা আসরে বলেন –

إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ
নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।

إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ

“কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...