সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সভ্যতা সম্পর্কে আল-ফারাবির চিন্তা

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম আবু নাসের মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ আল-ফারাবি। অধিবিদ্যা (Metaphysics), জ্ঞানতত্ত্ব ও রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারিয়ে যায় না।

ইবনে ফারাবির ‘নৈতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নগর’ (আল-মাদীনাহ আল ফাদিলাহ) ধারণাটি ইসলামী এবং গ্রীক নীতিশাস্ত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি নগর জীবন, সভ্যতা এবং অধিবিদ্যার মাঝে একটি সংযোগ সৃষ্টি করেছেন। যদিও এই ধারণাগুলোর সঠিক অর্থ আজ আমাদের পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু মানুষের উপযুক্ত আবাস হাজির থাকার জন্য এই ধারণাগুলোর পারস্পরিক সংযোগ একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাই আল-ফারাবির এই সংযোগ প্রচেষ্টাকে আবার পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজন রয়েছে।

সর্বপ্রথম ১৭৫৭ সালে, ‘ভিক্টর রিকেতি মিরাবু’ তার ‘মানুষের বন্ধু বা জনগণের চুক্তিনামা’ শীর্ষক গ্রন্থে ‘সভ্যতা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রায় দুই শতাব্দী পর একবিংশ শতাব্দীতে ‘স্যামুয়েল হান্টিংটন’ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তাঁর বিখ্যাত একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন, সেখানে সভ্যতার পরিবর্তে সরাসরি ‘সংঘাত’কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাঁর সংঘাত তত্ত্বটি বাজারীকরণের ফলে যে প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, আমরা এখনো তা মোকাবিলা করছি।

সভ্যতা শব্দটির আজ যে অপব্যবহার হচ্ছে, সেখানে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারক হিসাবে আল-ফারাবিকে আনা যেতে পারে। তাঁর ‘নৈতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নগর’ নামক সামাজিক মডেলটি প্লেটো-এরিস্টটলীয় চিন্তার উপর নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ইসলামের উন্নত জীবন, সুখ ও আধ্যাত্মিকতার ধারণাগুলোরও রয়েছে এই মডেলে।

আল-ফারাবীর মৌলিক প্রস্তাবনাটা হলো – আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতার ভিত্তি ব্যতীত কোনো সভ্যতা ও নগর জীবন-ই টেকসই হতে পারে না।

শহর হচ্ছে মানব জীবনের সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট একটি সামষ্টিক ব্যবস্থা। শহর মানুষের সত্তাগত একটি প্রয়োজন। কারণ, কোনো মানুষ একা একা বাস করতে পারে না এবং একা একা তার নিয়তি পূর্ণ করতে পারে না। এ কারণে মানুষের সত্তা ও নৈতিকতার ধারণা একটি অর্থপূর্ণ শহর গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে।

শহরের উদ্দেশ্য কেবল পাশবিক বাসনা পূরণ এবং অন্যের উপর আধিপত্য জাহির করা নয়, বরং একটি সুখী জীবনযাপন করাই শহরের উদ্দেশ্য। এরিস্টটলের ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘উন্নত জীবন’।

মানুষের সকল কার্যক্রমই নৈতিক পছন্দ ও অপছন্দের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই, শহর ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্য এবং পারস্পরিক সহানুভূতির উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে শহরের বাসিন্দারা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার করে এবং সর্বসাধারণের ভালোর জন্য কাজ করে সেটাই একটি ভালো শহর।

আল-ফারাবির সংজ্ঞা অনুসারে, সুখ ও উন্নত জীবন কেবল তখনি লাভ করা যায়, যখন কেউ সত্যের সন্ধান পায়, এবং ‘বিমূর্ত বুদ্ধিমত্তার (disembodied intellect) সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়।

বস্তুগত আবেদন ও কামনার বেড়াজালে আবদ্ধ এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বাইরেই থাকে বোধগম্য সত্যের দুনিয়া। ‘সত্য’ ব্যতীত আমরা না পারব প্রকৃতির হক আদায় করতে, আর না পারব মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করতে।

ইবন সিনা তাঁর মাস্টারপিস ‘শিফা’-এর মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, কিছু ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা ব্যতীত মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতাগুলো অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে না। আর তা তখনি কেবল সম্ভব হয়, যখন মানুষ সঠিক পথ (সুন্নাহ) এবং ন্যায়-নীতি (আদল)-এর দ্বারা পরিচালিত হয়।

দেখুন, ইবনে সিনা এখানে সমষ্টিগত জীবন, নগরায়ণ এবং সভ্যতাকে উচ্চতর নৈতিক ভিত্তির উপর স্থাপন করার জন্য ‘সুন্নাহ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর ‘সুন্নাহ’ শব্দটি এবং রাসূল (স)-এর ‘সুন্নাহ’ শব্দ দুটি একই। রাসূল (স)-এর সুন্নাহ হলো এমন একটি সঠিক পথ যা বিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা ও সৎকাজের মাধ্যমে জীবন পরিচালনার রূপরেখা প্রদান করে।

ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি সঠিক পদ্ধতিতে মদিনায় একটি ইসলামী শহর গড়ে তোলেন। মদিনার মুসলিম শাসনের একদম শুরুর দিকের মুসলিম সমাজ সেখানে শুধু নগর জীবনের স্বাদ-ই পায়নি, বরং একটি সভ্যতার ভিতরে থাকার অভিজ্ঞতাও লাভ করেছিল। মদিনার এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যৎ ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি তৈরি করেছিল। আমরা আজ বৈশ্বিক যে দুর্যোগের মুখে আছি, সেখানে নগর জীবন এবং সভ্যতার এই অর্থগুলো আমাদের পুনরুদ্ধার করা উচিত।

লেখক : ড. ইব্রাহিম কালিন 17_3_17

অনুবাদ : জোবায়ের আল মাহমুদ

মূল লেখা : দৈনিক সাবাহ

অনুবাদটি প্রাকাশিত হয়েছে : ইত্তেফাক

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মুসলিম চিন্তাবিদ ও মনীষীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা

বিংশ শতাব্দীর মুসলিম চিন্তাবিদদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ১. আয়াতুল্লাহ খমিনী – (ইরান, ১৯০২ - ১৯৮৯) ২. আল্লামা তাবাতাবাঈ – (ইরান, ১৯০৩ - ১৯৮১) ৩. আবুল আ’লা মওদুদী – (পাকিস্তান, ১৯০৩ - ১৯৭৯) ৪. মালিক বিন নাবী – (আলজেরিয়া, ১৯০৫ - ১৯৭৩) ৫. হাসান আল বান্না – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৪৯) ৬. সাইয়েদ কুতুব – (মিশর, ১৯০৬ - ১৯৬৬) ৭. নুর উদ্দিন তোপচু – (তুরস্ক, ১৯০৯ – ১৯৭৫ ৮. ফজলুর রহমান – (পাকিস্তান, ১৯১৯- ১৯৮৮) ৯. মুর্তাজা মোতাহারী – (ইরান, ১৯২০ - ১৯৭৯) ১০. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি - (ফিলিস্তিন, ১৯২১ - ১৯৮৬ ) ১১. আলী আইজাত বেগোভিচ – (বসনিয়া, ১৯২৫ - ২০০৩) ১২. নাজিমুদ্দিন এরবাকান – (তুরস্ক, ১৯২৬ - ২০১১) ১৩. শহীদ মোহাম্মদ বেহেশতী – (ইরান, ১৯২৮ - ১৯৮১) ১৪. নাকিব আল-আত্তাস – (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩১ - ) ১৫. হাসান আত-তুরাবী, (সুদান, ১৯৩২ - ২০১৬) ১৬. আলী শরিয়তি – (ইরান, ১৯৩৩ - ১৯৭৭) ১৭. সেজাই কারাকোচ - (তুরস্ক, ১৯৩৩ - ) ১৮. সাইয়্যেদ হোসাইন নাসর – (ইরান, ১৯৩৩ - ) ১৯. হাসান হানাফি – (মিশর, ১৯৩৫ - ) ২০. আবেদ আল জাবেরি – (মরক্কো, ১৯৩৬ - ২০১০) ২১. রশিদ ঘানুশী – (তিউনিসিয়া, ১৯৪১ - ) ২২. নাসের আবু জায়েদ – (মিশর, ১৯৪৩ - ২০

স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত দুই বিজ্ঞানীর দ্বন্দ্ব

স্টিফেন হকিং এবং মিচিও কাকু দু’জনই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে স্টিফেন হকিং-এর নামটি অনেক পরিচিত হলেও বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং-এর চেয়ে মিচিও কাকু-র অবদান অনেক বেশি। মিচিও কাকু হলেন ‘স্ট্রিং তত্ত্বের’ কো-ফাউন্ডার। এ তত্ত্বটি অতীতের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে পিছনে ফেলে বর্তমানে বিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছে। তাই বিশ্বের কাছে স্টিফেন হকিং এর চেয়ে মিচিও কাকু’র জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় সাধারণত বিজ্ঞানের কোনো বই পাওয়া না গেলেও সেখানে মিচিও কাকু-র বিজ্ঞান বিষয়ক তিনটি বই বেস্টসেলার হয়েছে। অবশ্য, সেই তালিকায় স্টিফেন হকিং-এর একটি বইও নেই। দু’জনেই সমসাময়িক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও স্রষ্টা ও ধর্ম নিয়ে দু’জনের অবস্থান দুই প্রান্তে।   ১ - ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বিতর্ক।   স্টিফেন হকিং তাঁর ‘The Grand Design’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন, ‘দর্শন মরে গেছে এবং ধর্ম অকার্যকর হয়ে গেছে, এখন কেবল বিজ্ঞানের যুগ’। তাঁর মতে, সত্য মানেই বিজ্ঞান। ধর্ম ও দর্শনের যাবতীয় সমস্যা বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। তাই, ধর্ম ও দর্শন এখন অপ্রয়

সকল জ্ঞান-ই ইসলামের সম্পদ

কোর'আন একটি জ্ঞান, হাদিস একটি জ্ঞান, ফিকাহ একটি জ্ঞান, দর্শন একটি জ্ঞান, এবং বিজ্ঞান একটি জ্ঞান। এদের মাঝে স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও একটি জ্ঞান কখনো অন্য জ্ঞানের বিরোধী হয় না। আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা প্রথম যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন, তা পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যেই রয়েছে। যে কেউ যে নামেই জ্ঞান চর্চা করুক না কেন, তা আল্লাহর সত্য জ্ঞানের সাথে কখনো বিরোধী হওয়া সম্ভব না। অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। এবং দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বৈপরীত্য রয়েছে। নাস্তিকরা মনে করেন, কোর'আনের এক আয়াতের সাথে অন্য আয়াতের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলুল কোর'আন মনে করেন, কোর'আনের সাথে হাদিসের বৈপরীত্য রয়েছে। আহলে হাদিস মনে করেন, হাদিসের সাথে ফিকহের বৈপরীত্য রয়েছে। কিছু কিছু ধার্মিক মনে করেন, ধর্মের সাথে দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞানী মনে করেন, বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম ও দর্শনের বৈপরীত্য রয়েছে। কিন্তু, আসলে সব জ্ঞান-ই আল্লাহর পক্