সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভিন্ন ধর্মের মানুষকে একই জাতি হিসাবে ঘোষণা দেয় মদিনার সনদে

রাসূল (স) যখন মদিনায় যান, তখন মদিনার জনসংখ্যা ছিলো ৪ থেকে ৫ হাজার। মক্কা থেকে আসা মুসলিমরা সহ মদিনায় মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো মাত্র কয়েক'শ। ইহুদিদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার। আর অন্যান্যরা ছিলো হিন্দুদের মতো মুশরিক।

আউস ও খাযরাজ সহ ইয়েমেন থেকে মদিনায় আসা আরবদের দল ছিলো প্রায় ১২টি। অন্যদিকে, বনু নাজীর, বনু কুরাইজা ও বনু কাইনুকা সহ ফিলিস্তিন থেকে আসা ইহুদিদের দল ছিলো প্রায় ১০টি। সব মিলিয়ে মদিনায় প্রায় ২০/২৫টি দল বা গোত্র ছিলো। সবাই একে অপরের সাথে যুদ্ধ করতো। অবশ্য তখন ফেইসবুক ছিলো না; যদি ফেইসবুক থাকতো, তাহলে সরাসরি যুদ্ধ করার প্রয়োজন হতো না।

সে যাই হোক, মদিনায় মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো কয়েক'শ, কিন্তু অ-মুসলিমদের সংখ্যা কয়েক হাজার ছিলো। রাসূল (স) মদিনায় এসে এমন একটি প্রস্তাবনা দিলেন, যাতে মদিনার সবাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে গেলো। রাসূলের সেই প্রস্তাবনাকে আরবিতে কিতাব বা সহিফা বলা হলেও, বাংলায় আমরা এটাকে মদিনার সনদ বলি।

মদিনার সনদ হলো পৃথিবীর প্রথম সংবিধান। কিন্তু, এই সংবিধানটা তথাকথিত 'ইসলামী সংবিধান' ছিলো না।

এই সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হয়, মক্কা থেকে আসা মুসলিমগণ, মদিনার সকল অধিবাসী (ইহুদি, মুশরিক ও মুসলিম) সবাই একই উম্মত বা একই জাতি। এ ছাড়া যারা মদিনার মানুষদেরকে অনুসরণ করবে, মদিনার মানুষদের সাথে থেকে যুদ্ধে সহায়তা করবে, তারাও এই একই উম্মত বা জাতির অন্তর্ভুক্ত।

هَذَا كِتَابٌ مِنْ مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ (رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ مِنْ قُرَيْشٍ وَأَهْلِ يَثْرِبَ، وَمَنْ تَبِعَهُمْ فَلَحِقَ بِهِمْ، فَحَلَّ مَعَهُمْ وَجَاهَدَ مَعَهُمْ، أَنَّهُمْ أُمَّةٌ وَاحِدَةٌ مِنْ دُونِ النَّاسِ.
[الأموال لابن زنجويه 2/ 466]

মদিনার এই সংবিধানটি ইসলামের দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি সংবিধান হলেও, এটি কিন্তু তথাকথিত 'ইসলামী সংবিধান' ছিলো না। এই সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদে চুরি ও যিনার শাস্তি নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি, মদ খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়নি, নারীদের পর্দা করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, মুসলিমদেরকে নামাজ-রোজা করার জন্যে বলা হয়নি, মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্যে বলা হয়নি, অথবা, আল্লাহকে বিশ্বাস করতেও বলা হয়নি। এ সংবিধানে কেবল মদিনার নাগরিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। হোক ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিক বা মুসলিম, এ সংবিধানে কারো ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়নি, বরং মদিনায় বসবাসকারী সকল নাগরিকের অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

মদিনার সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হয়, তখন মুসলিমদের সংখ্যা কয়েকশ ছিলো, কিন্তু, সংবিধানের প্রস্তাবনাগুলো ছিলো খুবই শক্তিশালী। বাংলাদেশে যারা নতুন দল গড়বেন, তারা সংখ্যায় কম হতে পারেন, কিন্তু তারা এমন একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের অধিকারকে নিশ্চিত করা যাবে।

রাসূল (স)-এর মদিনার মতো বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়েও নাগরিক অধিকারকে বড় করে দেখাই নতুন দলের কাজ।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

গণতন্ত্র সময়ের একটি চাহিদা

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনের কথা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? ধরুন, ১৬১৭ সাল। উসমানী খেলাফতের অধীনে তখন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ ভূমি। সেই এক-তৃতীয়াংশ ভূমির খেলাফতের দায়িত্ব পালন করছেন সুলতান আহমদ। কেউ যদি তখন বলতো, আমরা সুলতান আহমদের পরিবর্তন চাই এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। তাহলে তখন কিভাবে সে নির্বাচনটি হত? তখন তো আর ইন্টারনেট বা টেলিভিশন ছিল না, এমনকি প্লেনও ছিল না। নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচনী তফসিলটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রত্যেকের কাছে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে করতে কমপক্ষে ৩ বছর সময় লেগে যেতো। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকল মানুষ যেহেতু খলীফা প্রার্থী হবার অধিকার রাখে, সুতরাং নির্বাচন কমিশনারের কাছে তাঁদের মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে করতে সময় লাগতো আরো ২ বছর। নির্বাচন কমিশনার লক্ষ লক্ষ মনোনয়ন পত্র বাচাই করতে করতে লাগতো আরো ১ বছর। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের এবং আপিল নিষ্পত্তি করতে সময় লাগতো কমপক্ষে আরো ৫ বছর। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার সময় দিতে হতো কমপক্ষে আরো ১ বছর। কারণ প্রার্থীদেরকে বহুদূর থেকে এসে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হতো। তারপর, প্রা...