১
জোবায়ের আল মাহমুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। আমি সবাইকে পড়তে ও ভাবতে অনুরোধ করি। তিনি লিখেছেন:
"নতুন দল একটি কল্যাণ রাষ্ট্র চায়, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকেও উন্নত রাষ্ট্র।
একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মুসলিম দার্শনিক আল ফারাবী বলেন –
يكون كل واحد من أهلها مطلق خال بنفسه يعمل ما يشاء، أهلها يتساوون وسنتهم أن لا فضل لإنسان على إنسان في شيء أصلاً. ويكون أهلها أحرارًا يعملون ما يشاؤون ولا يكون لأحد على أحد منهم ولا من غيرهم سلطان إلا أن يعمل ما تزول به حريتهم.
[الفارابي : "السياسة المدنية"، تحقيق فوزي متري النجار ط 1 المطبعة الكاتوليكية بيروت في 1964 ص 99]
অর্থাৎ,
“একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের অধিবাসীরা প্রত্যেকে নিজেই নিজের অধীনে থাকবে, এবং সে যা ইচ্ছে, তা করতে পারবে। সে রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী হবে, কোনও একজন মানুষ অন্য মানুষের উপর বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত হবে না। এর অধিবাসীরা সবাই স্বাধীন, কেউ কারো উপর কর্তৃত্ব করতে পারবে না। তবে, কেউ কারো স্বাধীনতা হরণ করলে তখন ভিন্ন কথা”।
এখানে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট।
১) আল ফারাবীর কল্যাণ রাষ্ট্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার পাবে।
২) ধর্মীয় কারণে কেউ অধিক সুযোগ-সুবিধা পাবে না, বরং রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান সুবিধা পাবেন।
আল ফারাবীর “জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র”-এর ধারণা বর্তমান গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক বেশি উন্নত। বাংলাদেশের নতুন দলটি আল ফারাবির 'কল্যাণ রাষ্ট্র' গঠন করার চেষ্টা করবে বলে আমার বিশ্বাস।"
..................
যে কোন নতুন রাজনৈতিক চেষ্টাকে আমি স্বাগতম জানাই। সেটা সমাজের নতুন টানাপড়েনের লক্ষণ। শুরুতেই নতুন উদ্যোগের বিরুদ্ধে নিন্দা, অপপ্রচার ইত্যাদি নিন্দনীয়। তবে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে, সে বিষয়ে জোবায়েরসহ সকলেই গভীর ভাবে ভাববেন আশা করি। জোবায়েরের উদ্ধৃতি বিমূর্ত কথাবার্তা না বলে কংক্রিট ভাবে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে।
১. প্রথম প্রশ্ন আল ফারাবি মুসলমান দার্শনিক হলেও তিনি প্রাক-ইসলামিক গ্রিক অনুমান ও দর্শনেরই ধারবাহিকতা হিশাবেই পরিগণিত হয়ে এসেছেন। মুসলমান বলেই কেউ গ্রিক-খ্রিস্টিয় অনুমান, দর্শন ও রাজনীতি থেকে মুক্ত, এটা দাবি করা যায় না। স্রেফ মুসলমান বলেই আধুনিক জমানায় কেউ গ্রিক, খ্রিস্টান বা ইহুদিবাদী বা বিশ্বের অধিপতি চিন্তা থেকে মুক্ত নয়।
২. ফারাবির এই উদ্ধৃতি কি বিনা তর্কে মেনে নেওয়া উচিত? এটা মূলত আধুনিক লিবারেলিজম, অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ‘অধিকার’ মার্কা রাজনীতির বয়ান। আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী দিয়ে বড়লোকদের সম্পত্তি পাহারা দেওয়া এবং গরিব ও অসহায়কে বঞ্চিত করে পুঁজির পুঞ্জিভবন ও স্ফীতি নিশ্চিত করা, মুনাফাভিত্তিক সমাজ বহাল রাখা, ইত্যাদি। উদারবাদী ‘জনকল্যান মূলক’ রাষ্ট্রে বিশ্বাস করলে মানতে হবে পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘জনকল্যাণ’ নিশ্চিত করে! এটা নিছকই ইলিউশান এবং সর্বৈব মিথ্যা।
৩. এ কালে ‘জনকল্যাণ’ মার্কা তত্ত্বের অর্থ হচ্ছে তথাকথিত ইসলামি ‘সন্ত্রাস’-এর হাত থেকে নিরীহ জনগণকে রক্ষা করা। অর্থাৎ জনগণের কল্যাণের জন্য আইনবহির্ভূত হত্যা, গুমখুন, মামলা, হামলা, পুলিশি নির্যাতন চালানো। এই প্রকার 'জনকল্যণ'-এর তত্ত্ব আধুনিক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বৈধ করে। বাজার ব্যবস্থায় আধুনিক রাষ্ট্রের আর কোন ভূমিকা নাই তথাকথিত 'সিকিউরিটি' নিশ্চিত করা ছাড়া। কারন বাজারই বাকি সব কিছু করে। বাজারে কেউ টিকে থাকলে থাকবে, নইলে মরবে। ‘জনকল্যাণ’ বিমূর্ত কোন ধারণা নয়, বর্তমান বাস্তবতার নিরিখেই তার অর্থ বুঝে নিতে হবে।
৪. গ্রিক খ্রিস্টীয় অনুমান ও দর্শনের পরিমণ্ডলে বাসই যদি আমাদের একমাত্র নিয়তি হয় তাহলে ইসলাম দিয়ে আমাদের কী দরকার! আমরা খ্রিস্টান হয়ে গেলেই ভাল। ইসলামের আদৌ কোন স্বতন্ত্র জ্ঞানতাত্ত্বিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রস্তাবনা বা বৈশিষ্ট কি তাহলে নাই? কিম্বা কোরান হাদিস এবং মুসলমানদের আভ্যন্তরীন তর্ক ও জিজ্ঞাসা থেকে (discursive tradition), বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা অতিক্রম করে যাবার দিশা কি আমরা সন্ধান করবো না? ইজতিহাদ বা ইসলাহ কি অর্থহীন? গ্রিক-খ্রিস্টিয় পরিমণ্ডলের বাইরে অন্যেরা কি ইতিহাসের নতুন কোন অভিমুখ তৈরি করতে অক্ষম? ইসলামের কী কোনই নতুন প্রস্তাবনা নাই যা আমাদের বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা মোকাবিলা করবার সহায়ক? গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলেই আমাদের তাহলে চিন্তা করতে হবে, এর বাইরে কোন ‘ইসলাম’ নাই?
৫. জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সবাই ‘স্বাধীন’ -- এর অর্থ কী? ইসলাম মানুষকে ‘আল্লার খলিফা’ গণ্য করে, অর্থাৎ মানুষ দিব্যগুণের সম্ভাবনা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে, ধর্ম কিম্বা বিশ্বাস নির্বিশেষে দুনিয়ায় আল্লার তরফ থেকেই সকল মানুষের আগমন ঘটে --এর মর্ম বোঝাই একালে আমাদের কাজ। কিন্তু ‘স্বাধীন’, ‘সার্বভৌম ব্যক্তি’ গুরুতর বিতর্কের বিষয়। আধুনিক রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা কিম্বা ‘অন্যের স্বাধীনতা হরণ করা’ ইত্যাদি বকোয়াজগিরি চলে। কিন্তু এইসব বলতে আধুনিক রাষ্ট্র কী বোঝায় সেটা সংবিধানে নির্দিষ্ট থাকে, এক অনুচ্ছেদে স্বাধীনতার কথা বলে পরের অনুচ্ছেদে তা খর্ব করা হয়।
৬. তথাকথিত ‘মানুষ’ সমাজ বা সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন না। মানুষ কোন স্বাধীন বা সার্বভৌম সত্তা না। তাই জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সবাই স্বাধীন, কথাটা বিমূর্ত ও অর্থহীন।
মূল কথা হচ্ছে গ্রিক-খ্রিস্টিয় লিজেসি ও পরিমণ্ডলের পর্যালোচনা এবং সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসাই কি আমাদের প্রধান কর্তব্য নয়? এটাই একালের রাজনীতি। পাশ্চাত্য গ্রিক-খ্রিস্টিয় লিজেসির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আমাদের কাজ না। অন্তত ইসলামে বিশ্বাসীদের তো নয়ই।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10157365816365742&id=718000741
২
ফরহাদ মজহার ভাইয়ের এই পয়েন্টগুলো নিয়ে সবার ভাবা উচিত, বিশেষ করে যারা নতুন রাজনীতি করতে চান, তাঁদের ভাবা উচিত।
অনেকগুলো বিষয়ে ফরহাদ ভাই প্রশ্ন তুলেছেন, যা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা প্রয়োজন, এবং আমি আমার সমর্থ অনুযায়ী ধীরে ধীরে কিছু ভাববো, এবং লিখতে চেষ্টা করবো।
১নং পয়েন্টে ফরহাদ ভাই বলেছেন -
//প্রথম প্রশ্ন আল ফারাবি মুসলমান দার্শনিক হলেও তিনি প্রাক-ইসলামিক গ্রিক অনুমান ও দর্শনেরই ধারাবাহিকতা হিশাবেই পরিগণিত হয়ে এসেছেন। মুসলমান বলেই কেউ গ্রিক-খ্রিস্টীয় অনুমান, দর্শন ও রাজনীতি থেকে মুক্ত, এটা দাবি করা যায় না। স্রেফ মুসলমান বলেই আধুনিক জমানায় কেউ গ্রিক, খ্রিস্টান বা ইহুদিবাদী বা বিশ্বের অধিপতি চিন্তা থেকে মুক্ত নয়।//
ফরহাদ ভাইয়ের উপরোক্ত পয়েন্টের বিষয়ে আমার কথা হলো -
গ্রিক দার্শনিকদের ১০০০ (এক হাজার) বছর পরে আল ফারাবির জন্ম। সুতরাং এক হাজার বছর পর্যন্ত গ্রিক অনুমান ও দর্শন স্থির হয়ে বসে থাকেনি। ফারাবি জন্মের পূর্বেই প্লেটো-এরিস্টটলের চিন্তাগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা হয়েছে। ইতোমধ্যে মুসলিমদের কালাম ও মানতিক শাস্ত্র একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করেছিলো। ফলে, ফারাবি কোনো ভাবেই গ্রিক অনুমান ও দর্শনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেননি। বরং, গ্রিক অনুমানের যে ভ্রান্তিগুলো ১০০০ বছর ধরে পর্যালোচনা হয়েছিলো, সেগুলো থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছেন ফারাবি। একইসাথে ইসলামের মূল্যবোধ ভিত্তিক আকাঈদ, কালাম ও মানতিক শাস্ত্রের মূলনীতিগুলো ফারাবির দর্শনে স্থান পেয়েছিলো।
কোনো একটি দর্শন বা চিন্তা শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না। পূর্বের চিন্তা ও দর্শনের পর্যালোচনার মাধ্যমেই নতুন চিন্তা ও দর্শন সৃষ্টি হয়। ফলে, ফারাবি গ্রিক দর্শনের পর্যালোচনা করে নতুন যে চিন্তা দিয়েছেন, সেটাকে ফারাবির মতোই বুঝা প্রয়োজন, গ্রিক অনুমান দিয়ে নয়।
ইসলামী দর্শন মোটা দাগে তিন প্রকার।
১) প্রাকৃতিক দর্শন (তাবিয়াত ফালসাফা)। গ্রিক পূর্ব ভারতীয় দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত দর্শন।
২) মাশায়ী দর্শন। গ্রিক দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত দর্শন।
৩) ইশরাক দর্শন। ইরানের দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত দর্শন।
ফারাবি উপরোক্ত তিনটি দর্শন দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন।
ফারাবি ছাড়াও মাশায়ী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন আল কিন্দি, ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ। এই চারজন মাশায়ী দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও সবার চিন্তার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং, ফারাবিকে গ্রিক অনুমান ও দর্শনেরই ধারাবাহিকতা হিশাবেই পরিগণিত করলে অনেক ভুল হয়ে যায়। ফারাবি গ্রিক চিন্তা ও দর্শনের যে পর্যালোচনা-সমালোচনা করেছেন, তা আমাদের আমলে নিতে হবে।
৩
আল ফারাবির 'কল্যাণ রাষ্ট্র' নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ফরহাদ মজহার ভাই। তাঁর প্রশ্নের একটি অংশের জবাব পাওয়া যাবে নিচের আর্টিকেলটিতে।
গ্রিক-রোমান দার্শনিকদেরকে পর্যালোচনা করে ফারাবি কিভাবে ইসলামী ভিত্তির ওপর তাঁর তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন, সে বিষয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন তুরস্কের একাডেমিক ইব্রাহীম কালীন। ইব্রাহীম কালীন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রেস সচিব। কালিনের আর্টিকেলটি অনেক আগে অনুবাদ করেছিলাম, এখন ফারাবির আলোচনা আসায় নতুন করে আবার শেয়ার করলাম। বর্তমান পশ্চিমা চিন্তার সাথে আল ফারাবির পার্থক্য করার জন্যে এ আর্টিকেলটি গুরুত্বপূর্ণ।
আল ফারাবির সভ্যতার ধারণা - ইব্রাহীম কালীন।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম আবু নাসের মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ আল-ফারাবি (৮৭২-৯৫০)। অধিবিদ্যা (Metaphysics), জ্ঞানতত্ত্ব অথবা রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারিয়ে যায় না। ইবনে ফারাবির ‘নৈতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নগর’ (আল-মাদীনাহ্ আল ফাদিলাহ্) ধারণাটি ইসলামী এবং গ্রীক নীতিশাস্ত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি নগর জীবন, সভ্যতা এবং অধিবিদ্যার মাঝে একটি সংযোগ সৃষ্টি করেছেন। যদিও এই ধারণাগুলো সঠিক অর্থে আমাদের পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু মানুষের উপযুক্ত আবাস হাজির থাকার জন্য এই ধারণাগুলোর পারস্পরিক সংযোগ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আল-ফারাবির এই সংযোগ প্রচেষ্টাকে তাই পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজন রয়েছে।
১৭৫৭ সালে ‘সভ্যতা’ শব্দটি প্রথম ভিক্টর রিকেতি মিরাবু তার ‘মানুষের বন্ধু বা জনগণের চুক্তিনামা’ (traitÍ• de la population L’ami des hommes ou) শীর্ষক গ্রন্থে ব্যবহার করেন। প্রায় দুই শতাব্দী পর একবিংশ শতাব্দীতে স্যামুয়েল হান্টিংটন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তাঁর বিখ্যাত একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন, সেখানে সভ্যতার পরিবর্তে সরাসরি ‘সংঘাত’কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাঁর সংঘাত তত্ত্বের বাজারীকরণের ফলে যে প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, আমরা এখনো তা মোকাবিলা করছি। সভ্যতা শব্দটির আজ যে অপব্যবহার হচ্ছে, সেখানে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারক হিসাবে আল-ফারাবিকে আনা যেতে পারে। তাঁর মডেল ‘নৈতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নগর’ (আল-মাদীনাহ্ আল ফাদিলাহ্) প্লেটো-এরিস্টটলীয় চিন্তার এবং সেইসঙ্গে ইসলামের উন্নত জীবন, সুখ ও অধিবিদ্যা ধারণাগুলোর ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর মৌলিক প্রস্তাবনাটা হলো অধিবিদ্যা এবং নৈতিকতার ভিত্তি ব্যতীত কোনো সভ্যতা ও নগর জীবন টেকসই হতে পারে না। শহর হচ্ছে মানব জীবনের সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য সর্বোত্কৃষ্ট একটি সামষ্টিক ব্যবস্থা। শহর মানুষের সত্তাগত একটি প্রয়োজন; কারণ, কোনো মানুষ একা একা বাস করতে পারে না এবং একা একা তার নিয়তি পূর্ণ করতে পারে না। এ কারণে মানুষের সত্তা ও নৈতিকতার ধারণা একটি অর্থপূর্ণ শহরের আকার গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে, যেখানে কেবল পাশবিক বাসনা পূরণ এবং অন্যের উপর আধিপত্য জাহির করা প্রধান নয় বরং একটি সুখী জীবনযাপন করাই উদ্দেশ্য; এরিস্টটলের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘উন্নত জীবন’।
মানুষের সকল কার্যক্রমই নৈতিক পছন্দ ও অপছন্দের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাই, শহর ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্য এবং পারস্পরিক সহানুভূতির উত্কর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে শহরের বাসিন্দারা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার করে এবং সর্বসাধারণের ভালোর জন্য কাজ করে সেটাই একটি ভালো শহর। আল-ফারাবির সংজ্ঞা অনুসারে, সুখ ও উন্নত জীবন কেবল তখনি লাভ করা যায়, যখন কেউ সত্যের সন্ধান পায় এবং ‘বিমূর্ত বুদ্ধিমত্তার (disembodied intellect) সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়’ অর্থাত্ বস্তুগত আবেদন ও কামনার বেড়াজালে আবদ্ধ এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বাইরে বোধগম্য সত্যের দুনিয়া। ‘সত্য’ ব্যতীত আমরা না পারব প্রকৃতির হক আদায় করতে, আর না পারব মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করতে।
ইবন সিনা তাঁর মাস্টারপিস ‘শিফা’-এর মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, কিছু ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা ব্যতীত মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতাগুলো অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে না; আর তা তখনি কেবল সম্ভব হয়, যখন মানুষ সঠিক পথ (সুন্নাহ্) এবং ন্যায়-নীতি (আদল)-এর দ্বারা পরিচালিত হয়। দেখুন, ইবনে সিনা এখানে সমষ্টিগত জীবন, নগরায়ণ এবং সভ্যতাকে উচ্চতর নৈতিক ভিত্তির উপর স্থাপন করার জন্য ‘সুন্নাহ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এখানের ‘সুন্নাহ্’ শব্দটি এবং রাসূল (স)-এর সুন্নাহ শব্দ দুটি একই। রাসূল (স)-এর সুন্নাহ্ হলো এমন একটি সঠিক পথ যা বিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা ও সত্কাজের উপর ভিত্তি করে জীবন পরিচালনার রূপরেখা প্রদান করে।
ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি সঠিক পদ্ধতিতে মদীনায় একটি ইসলামী শহর গড়ে তোলেন। মদীনার মুসলিম শাসনের একদম শুরুর দিকের মুসলিম সমাজ সেখানে শুধু নগর জীবনের স্বাদ-ই পায়নি, বরং একটি সভ্যতার ভিতরে থাকার অভিজ্ঞতাও লাভ করেছিল। মদীনার এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যত্ ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি তৈরি করেছিল। আমরা আজ বৈশ্বিক যে দুর্যোগের মুখে আছি, সেখানে নগর জীবন এবং সভ্যতার এই অর্থগুলো আমাদের পুনরুদ্ধার করা উচিত।
৪
তরুণদের মধ্যে যারা ইসলাম নিয়ে ভাবছেন জোবায়ের আল মাহমুদ তাদের মধ্যে আমার অতি প্রিয়দের একজন। বাংলাদেশে আমাদের প্রচুর ভাবুক, তার্কিক ও ইতিহাসবিদ দরকার। বিশেষত যারা আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষা জানেন এবং বাংলায় লিখতে পারেন। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য ও আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হলে আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় ইসলাম সংক্রান্ত বইপত্র সরাসরি পড়তে পারার দক্ষতা এবং সেইসব লেখার কালোপযোগী ব্যাখ্যার হিম্মত তরুণদের অর্জন করা দরকার।
আল ফারাবি থেকে একটি বিক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি দেখে জোবায়েরের একটি স্টেটাসে আমি মন্তব্য প্রয়োজনীয় মনে করেছি। এই উদ্ধৃতিতে আল ফারাবিকে ভুল বোঝার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ফারাবি গ্রিক চিন্তার দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত ছিলেন। ফলে আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তায় উদ্বুদ্ধ লিবারেল রাজনৈতিক চিন্তার উপাদান তার মধ্যে থাকা খুবই স্বাভাবিক। উদ্ধৃতিটি ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করেছে, বাংলাদেশে পাশ্চাত্যের উদার রাজনৈতিক চিন্তার সপক্ষেই উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয়েছে। আমার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জোবায়ের বলছেন, 'ফারাবি কোনো ভাবেই গ্রিক অনুমান ও দর্শনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেননি'। এই দাবি তর্ক সাপেক্ষ। সেটা নাহয় আপাতত তোলা রইল। প্রশ্ন হচ্ছে যদি তাই হয় তাহলে জোবায়ের আধুনিক লিবারেল রাজনীতির সপক্ষে ফারাবির এই উদ্ধৃতি কোথায় পেলেন? আর কেনই বা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্ততায় ঠিক এই ধরণের উদ্ধৃতি দিলেন?
এতে আল ফারাবি সম্পর্কে পাঠক ভুল ধারণা পাবেন মনে করে একান্তই উদ্ধৃতিটি কেন্দ্র করেই আমি মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছি। বলাবাহুল্য, আমার মন্তব্য ফারাবির সমালোচনা ও পর্যালোচনা নয়। জোবায়ের এখন আল ফারাবি সম্পর্কে লিখছেন। সেটা ভাল। কিন্তু আমার মন্তব্য একান্তই পাশ্চাত্যের উদারবাদী চিন্তা ও রাজনীতি প্রসঙ্গে। আল ফারাবির মধ্যে যার উপাদান রয়েছে। পাশ্চাত্যের উদারবাদী চিন্তা ও রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সকল তরুণের কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
‘স্বাধীন অধিবাসী’দের নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা প্রাচীন ও পশ্চাতপদ। ব্যক্তি স্বাধীন এবং ব্যক্তির ইচ্ছা সার্বভৌম – আধুনিক গণতন্ত্রের এইসকল যারপরনাই ফালতু ও অন্তঃসারশূন্য কেচ্ছা বিশ্বাস করার কারণে এই ধরণের আজগবি রাষ্ট্রের চিন্তা আমরা করি। যখন টেলিভিশান বা মিডিয়াতে কোম্পানির বিজ্ঞাপন দৈনন্দিন আমাদের ইচ্ছা, কামনা ও বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করে আর অধিবাসীসকল করপোরেট বাণিজ্যের গোলামে পরিণত, সেখানে ব্যক্তি ‘স্বাধীন’ ও ‘সার্বভৌম’ কথাটা আধুনিক জীবনের বিকট অন্তঃসারশূন্যতা লুকাবার জন্যই ব্যবহার করা হয়।
এই লিবারেল মতাদর্শ একান্তই পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের অভিব্যক্তি। এই সমাজেই আমরা পরাধীন হয়েও নিজেদের ‘স্বাধীন’ ভাবি। এর ফলে ইসলাম যখন নিঃশর্ত আত্মসমর্পন’ কথাটা বলে, তখন তথাকথিত 'ব্যক্তি স্বাধীনতা'র বিরুদ্ধে ইসলাম দানব হিশাবে হাজির হয়। ইসলাম কেন কথাটা বলে তার মর্মে প্রবেশের তাগিদ শুরুতেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পন’ কথাকে ব্যাখা করা হয় অতিশয় হিংস্র, পশ্চাতপদ ও গণমানুষের দুষমণ এক শ্রেণির ক্ষমতাশালী আলেম ওলেমাদের ফতোয়ার কাছে আত্মসমর্পণ হিশাবে, অর্থাৎ ইসলাম হয়ে ওঠে এক প্রকার স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব বা অথরিটি, হয়ে ওঠে মানুষকে জিম্মি করবার জন্য ধর্মীয় পুরোহিতদের ধর্মীয়(?) মতাদর্শ।
আশা করব তরুণরা ফারাবিসহ মুসলমান দার্শনিকদের আরও মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করবেন, যাতে ফারাবির কালে গ্রিক চিন্তা ও ইসলামের টানাপড়েন ভাল ভাবে বোঝা যায়।
জোবায়ের উত্তর দিচ্ছেন, এতে আমি খুবই আনন্দিত। আশা করি আমরা একটি শক্তিশালী চিন্তার ধারা গড়ে তুলতে পারব যাতে বাংলাদেশে শক্তিশালী গণমানুষের রাজনৈতিক ধারার আবির্ভাব ত্বরান্বিত হয়।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10157368363420742&id=718000741
জোবায়ের আল মাহমুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। আমি সবাইকে পড়তে ও ভাবতে অনুরোধ করি। তিনি লিখেছেন:
"নতুন দল একটি কল্যাণ রাষ্ট্র চায়, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকেও উন্নত রাষ্ট্র।
একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মুসলিম দার্শনিক আল ফারাবী বলেন –
يكون كل واحد من أهلها مطلق خال بنفسه يعمل ما يشاء، أهلها يتساوون وسنتهم أن لا فضل لإنسان على إنسان في شيء أصلاً. ويكون أهلها أحرارًا يعملون ما يشاؤون ولا يكون لأحد على أحد منهم ولا من غيرهم سلطان إلا أن يعمل ما تزول به حريتهم.
[الفارابي : "السياسة المدنية"، تحقيق فوزي متري النجار ط 1 المطبعة الكاتوليكية بيروت في 1964 ص 99]
অর্থাৎ,
“একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের অধিবাসীরা প্রত্যেকে নিজেই নিজের অধীনে থাকবে, এবং সে যা ইচ্ছে, তা করতে পারবে। সে রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী হবে, কোনও একজন মানুষ অন্য মানুষের উপর বিশেষ মর্যাদা প্রাপ্ত হবে না। এর অধিবাসীরা সবাই স্বাধীন, কেউ কারো উপর কর্তৃত্ব করতে পারবে না। তবে, কেউ কারো স্বাধীনতা হরণ করলে তখন ভিন্ন কথা”।
এখানে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট।
১) আল ফারাবীর কল্যাণ রাষ্ট্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার পাবে।
২) ধর্মীয় কারণে কেউ অধিক সুযোগ-সুবিধা পাবে না, বরং রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান সুবিধা পাবেন।
আল ফারাবীর “জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র”-এর ধারণা বর্তমান গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক বেশি উন্নত। বাংলাদেশের নতুন দলটি আল ফারাবির 'কল্যাণ রাষ্ট্র' গঠন করার চেষ্টা করবে বলে আমার বিশ্বাস।"
..................
যে কোন নতুন রাজনৈতিক চেষ্টাকে আমি স্বাগতম জানাই। সেটা সমাজের নতুন টানাপড়েনের লক্ষণ। শুরুতেই নতুন উদ্যোগের বিরুদ্ধে নিন্দা, অপপ্রচার ইত্যাদি নিন্দনীয়। তবে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে, সে বিষয়ে জোবায়েরসহ সকলেই গভীর ভাবে ভাববেন আশা করি। জোবায়েরের উদ্ধৃতি বিমূর্ত কথাবার্তা না বলে কংক্রিট ভাবে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে।
১. প্রথম প্রশ্ন আল ফারাবি মুসলমান দার্শনিক হলেও তিনি প্রাক-ইসলামিক গ্রিক অনুমান ও দর্শনেরই ধারবাহিকতা হিশাবেই পরিগণিত হয়ে এসেছেন। মুসলমান বলেই কেউ গ্রিক-খ্রিস্টিয় অনুমান, দর্শন ও রাজনীতি থেকে মুক্ত, এটা দাবি করা যায় না। স্রেফ মুসলমান বলেই আধুনিক জমানায় কেউ গ্রিক, খ্রিস্টান বা ইহুদিবাদী বা বিশ্বের অধিপতি চিন্তা থেকে মুক্ত নয়।
২. ফারাবির এই উদ্ধৃতি কি বিনা তর্কে মেনে নেওয়া উচিত? এটা মূলত আধুনিক লিবারেলিজম, অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ‘অধিকার’ মার্কা রাজনীতির বয়ান। আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী দিয়ে বড়লোকদের সম্পত্তি পাহারা দেওয়া এবং গরিব ও অসহায়কে বঞ্চিত করে পুঁজির পুঞ্জিভবন ও স্ফীতি নিশ্চিত করা, মুনাফাভিত্তিক সমাজ বহাল রাখা, ইত্যাদি। উদারবাদী ‘জনকল্যান মূলক’ রাষ্ট্রে বিশ্বাস করলে মানতে হবে পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘জনকল্যাণ’ নিশ্চিত করে! এটা নিছকই ইলিউশান এবং সর্বৈব মিথ্যা।
৩. এ কালে ‘জনকল্যাণ’ মার্কা তত্ত্বের অর্থ হচ্ছে তথাকথিত ইসলামি ‘সন্ত্রাস’-এর হাত থেকে নিরীহ জনগণকে রক্ষা করা। অর্থাৎ জনগণের কল্যাণের জন্য আইনবহির্ভূত হত্যা, গুমখুন, মামলা, হামলা, পুলিশি নির্যাতন চালানো। এই প্রকার 'জনকল্যণ'-এর তত্ত্ব আধুনিক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বৈধ করে। বাজার ব্যবস্থায় আধুনিক রাষ্ট্রের আর কোন ভূমিকা নাই তথাকথিত 'সিকিউরিটি' নিশ্চিত করা ছাড়া। কারন বাজারই বাকি সব কিছু করে। বাজারে কেউ টিকে থাকলে থাকবে, নইলে মরবে। ‘জনকল্যাণ’ বিমূর্ত কোন ধারণা নয়, বর্তমান বাস্তবতার নিরিখেই তার অর্থ বুঝে নিতে হবে।
৪. গ্রিক খ্রিস্টীয় অনুমান ও দর্শনের পরিমণ্ডলে বাসই যদি আমাদের একমাত্র নিয়তি হয় তাহলে ইসলাম দিয়ে আমাদের কী দরকার! আমরা খ্রিস্টান হয়ে গেলেই ভাল। ইসলামের আদৌ কোন স্বতন্ত্র জ্ঞানতাত্ত্বিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রস্তাবনা বা বৈশিষ্ট কি তাহলে নাই? কিম্বা কোরান হাদিস এবং মুসলমানদের আভ্যন্তরীন তর্ক ও জিজ্ঞাসা থেকে (discursive tradition), বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা অতিক্রম করে যাবার দিশা কি আমরা সন্ধান করবো না? ইজতিহাদ বা ইসলাহ কি অর্থহীন? গ্রিক-খ্রিস্টিয় পরিমণ্ডলের বাইরে অন্যেরা কি ইতিহাসের নতুন কোন অভিমুখ তৈরি করতে অক্ষম? ইসলামের কী কোনই নতুন প্রস্তাবনা নাই যা আমাদের বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা মোকাবিলা করবার সহায়ক? গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলেই আমাদের তাহলে চিন্তা করতে হবে, এর বাইরে কোন ‘ইসলাম’ নাই?
৫. জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সবাই ‘স্বাধীন’ -- এর অর্থ কী? ইসলাম মানুষকে ‘আল্লার খলিফা’ গণ্য করে, অর্থাৎ মানুষ দিব্যগুণের সম্ভাবনা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে, ধর্ম কিম্বা বিশ্বাস নির্বিশেষে দুনিয়ায় আল্লার তরফ থেকেই সকল মানুষের আগমন ঘটে --এর মর্ম বোঝাই একালে আমাদের কাজ। কিন্তু ‘স্বাধীন’, ‘সার্বভৌম ব্যক্তি’ গুরুতর বিতর্কের বিষয়। আধুনিক রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা কিম্বা ‘অন্যের স্বাধীনতা হরণ করা’ ইত্যাদি বকোয়াজগিরি চলে। কিন্তু এইসব বলতে আধুনিক রাষ্ট্র কী বোঝায় সেটা সংবিধানে নির্দিষ্ট থাকে, এক অনুচ্ছেদে স্বাধীনতার কথা বলে পরের অনুচ্ছেদে তা খর্ব করা হয়।
৬. তথাকথিত ‘মানুষ’ সমাজ বা সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন না। মানুষ কোন স্বাধীন বা সার্বভৌম সত্তা না। তাই জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সবাই স্বাধীন, কথাটা বিমূর্ত ও অর্থহীন।
মূল কথা হচ্ছে গ্রিক-খ্রিস্টিয় লিজেসি ও পরিমণ্ডলের পর্যালোচনা এবং সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসাই কি আমাদের প্রধান কর্তব্য নয়? এটাই একালের রাজনীতি। পাশ্চাত্য গ্রিক-খ্রিস্টিয় লিজেসির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আমাদের কাজ না। অন্তত ইসলামে বিশ্বাসীদের তো নয়ই।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10157365816365742&id=718000741
২
ফরহাদ মজহার ভাইয়ের এই পয়েন্টগুলো নিয়ে সবার ভাবা উচিত, বিশেষ করে যারা নতুন রাজনীতি করতে চান, তাঁদের ভাবা উচিত।
অনেকগুলো বিষয়ে ফরহাদ ভাই প্রশ্ন তুলেছেন, যা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা প্রয়োজন, এবং আমি আমার সমর্থ অনুযায়ী ধীরে ধীরে কিছু ভাববো, এবং লিখতে চেষ্টা করবো।
১নং পয়েন্টে ফরহাদ ভাই বলেছেন -
//প্রথম প্রশ্ন আল ফারাবি মুসলমান দার্শনিক হলেও তিনি প্রাক-ইসলামিক গ্রিক অনুমান ও দর্শনেরই ধারাবাহিকতা হিশাবেই পরিগণিত হয়ে এসেছেন। মুসলমান বলেই কেউ গ্রিক-খ্রিস্টীয় অনুমান, দর্শন ও রাজনীতি থেকে মুক্ত, এটা দাবি করা যায় না। স্রেফ মুসলমান বলেই আধুনিক জমানায় কেউ গ্রিক, খ্রিস্টান বা ইহুদিবাদী বা বিশ্বের অধিপতি চিন্তা থেকে মুক্ত নয়।//
ফরহাদ ভাইয়ের উপরোক্ত পয়েন্টের বিষয়ে আমার কথা হলো -
গ্রিক দার্শনিকদের ১০০০ (এক হাজার) বছর পরে আল ফারাবির জন্ম। সুতরাং এক হাজার বছর পর্যন্ত গ্রিক অনুমান ও দর্শন স্থির হয়ে বসে থাকেনি। ফারাবি জন্মের পূর্বেই প্লেটো-এরিস্টটলের চিন্তাগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা হয়েছে। ইতোমধ্যে মুসলিমদের কালাম ও মানতিক শাস্ত্র একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করেছিলো। ফলে, ফারাবি কোনো ভাবেই গ্রিক অনুমান ও দর্শনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেননি। বরং, গ্রিক অনুমানের যে ভ্রান্তিগুলো ১০০০ বছর ধরে পর্যালোচনা হয়েছিলো, সেগুলো থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছেন ফারাবি। একইসাথে ইসলামের মূল্যবোধ ভিত্তিক আকাঈদ, কালাম ও মানতিক শাস্ত্রের মূলনীতিগুলো ফারাবির দর্শনে স্থান পেয়েছিলো।
কোনো একটি দর্শন বা চিন্তা শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না। পূর্বের চিন্তা ও দর্শনের পর্যালোচনার মাধ্যমেই নতুন চিন্তা ও দর্শন সৃষ্টি হয়। ফলে, ফারাবি গ্রিক দর্শনের পর্যালোচনা করে নতুন যে চিন্তা দিয়েছেন, সেটাকে ফারাবির মতোই বুঝা প্রয়োজন, গ্রিক অনুমান দিয়ে নয়।
ইসলামী দর্শন মোটা দাগে তিন প্রকার।
১) প্রাকৃতিক দর্শন (তাবিয়াত ফালসাফা)। গ্রিক পূর্ব ভারতীয় দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত দর্শন।
২) মাশায়ী দর্শন। গ্রিক দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত দর্শন।
৩) ইশরাক দর্শন। ইরানের দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত দর্শন।
ফারাবি উপরোক্ত তিনটি দর্শন দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন।
ফারাবি ছাড়াও মাশায়ী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন আল কিন্দি, ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ। এই চারজন মাশায়ী দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও সবার চিন্তার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং, ফারাবিকে গ্রিক অনুমান ও দর্শনেরই ধারাবাহিকতা হিশাবেই পরিগণিত করলে অনেক ভুল হয়ে যায়। ফারাবি গ্রিক চিন্তা ও দর্শনের যে পর্যালোচনা-সমালোচনা করেছেন, তা আমাদের আমলে নিতে হবে।
৩
আল ফারাবির 'কল্যাণ রাষ্ট্র' নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ফরহাদ মজহার ভাই। তাঁর প্রশ্নের একটি অংশের জবাব পাওয়া যাবে নিচের আর্টিকেলটিতে।
গ্রিক-রোমান দার্শনিকদেরকে পর্যালোচনা করে ফারাবি কিভাবে ইসলামী ভিত্তির ওপর তাঁর তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন, সে বিষয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন তুরস্কের একাডেমিক ইব্রাহীম কালীন। ইব্রাহীম কালীন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রেস সচিব। কালিনের আর্টিকেলটি অনেক আগে অনুবাদ করেছিলাম, এখন ফারাবির আলোচনা আসায় নতুন করে আবার শেয়ার করলাম। বর্তমান পশ্চিমা চিন্তার সাথে আল ফারাবির পার্থক্য করার জন্যে এ আর্টিকেলটি গুরুত্বপূর্ণ।
আল ফারাবির সভ্যতার ধারণা - ইব্রাহীম কালীন।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম আবু নাসের মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ আল-ফারাবি (৮৭২-৯৫০)। অধিবিদ্যা (Metaphysics), জ্ঞানতত্ত্ব অথবা রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারিয়ে যায় না। ইবনে ফারাবির ‘নৈতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নগর’ (আল-মাদীনাহ্ আল ফাদিলাহ্) ধারণাটি ইসলামী এবং গ্রীক নীতিশাস্ত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি নগর জীবন, সভ্যতা এবং অধিবিদ্যার মাঝে একটি সংযোগ সৃষ্টি করেছেন। যদিও এই ধারণাগুলো সঠিক অর্থে আমাদের পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু মানুষের উপযুক্ত আবাস হাজির থাকার জন্য এই ধারণাগুলোর পারস্পরিক সংযোগ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আল-ফারাবির এই সংযোগ প্রচেষ্টাকে তাই পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজন রয়েছে।
১৭৫৭ সালে ‘সভ্যতা’ শব্দটি প্রথম ভিক্টর রিকেতি মিরাবু তার ‘মানুষের বন্ধু বা জনগণের চুক্তিনামা’ (traitÍ• de la population L’ami des hommes ou) শীর্ষক গ্রন্থে ব্যবহার করেন। প্রায় দুই শতাব্দী পর একবিংশ শতাব্দীতে স্যামুয়েল হান্টিংটন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর তাঁর বিখ্যাত একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন, সেখানে সভ্যতার পরিবর্তে সরাসরি ‘সংঘাত’কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাঁর সংঘাত তত্ত্বের বাজারীকরণের ফলে যে প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, আমরা এখনো তা মোকাবিলা করছি। সভ্যতা শব্দটির আজ যে অপব্যবহার হচ্ছে, সেখানে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারক হিসাবে আল-ফারাবিকে আনা যেতে পারে। তাঁর মডেল ‘নৈতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নগর’ (আল-মাদীনাহ্ আল ফাদিলাহ্) প্লেটো-এরিস্টটলীয় চিন্তার এবং সেইসঙ্গে ইসলামের উন্নত জীবন, সুখ ও অধিবিদ্যা ধারণাগুলোর ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর মৌলিক প্রস্তাবনাটা হলো অধিবিদ্যা এবং নৈতিকতার ভিত্তি ব্যতীত কোনো সভ্যতা ও নগর জীবন টেকসই হতে পারে না। শহর হচ্ছে মানব জীবনের সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য সর্বোত্কৃষ্ট একটি সামষ্টিক ব্যবস্থা। শহর মানুষের সত্তাগত একটি প্রয়োজন; কারণ, কোনো মানুষ একা একা বাস করতে পারে না এবং একা একা তার নিয়তি পূর্ণ করতে পারে না। এ কারণে মানুষের সত্তা ও নৈতিকতার ধারণা একটি অর্থপূর্ণ শহরের আকার গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে, যেখানে কেবল পাশবিক বাসনা পূরণ এবং অন্যের উপর আধিপত্য জাহির করা প্রধান নয় বরং একটি সুখী জীবনযাপন করাই উদ্দেশ্য; এরিস্টটলের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘উন্নত জীবন’।
মানুষের সকল কার্যক্রমই নৈতিক পছন্দ ও অপছন্দের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাই, শহর ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্য এবং পারস্পরিক সহানুভূতির উত্কর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে শহরের বাসিন্দারা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার করে এবং সর্বসাধারণের ভালোর জন্য কাজ করে সেটাই একটি ভালো শহর। আল-ফারাবির সংজ্ঞা অনুসারে, সুখ ও উন্নত জীবন কেবল তখনি লাভ করা যায়, যখন কেউ সত্যের সন্ধান পায় এবং ‘বিমূর্ত বুদ্ধিমত্তার (disembodied intellect) সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়’ অর্থাত্ বস্তুগত আবেদন ও কামনার বেড়াজালে আবদ্ধ এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বাইরে বোধগম্য সত্যের দুনিয়া। ‘সত্য’ ব্যতীত আমরা না পারব প্রকৃতির হক আদায় করতে, আর না পারব মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করতে।
ইবন সিনা তাঁর মাস্টারপিস ‘শিফা’-এর মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, কিছু ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা ব্যতীত মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতাগুলো অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে না; আর তা তখনি কেবল সম্ভব হয়, যখন মানুষ সঠিক পথ (সুন্নাহ্) এবং ন্যায়-নীতি (আদল)-এর দ্বারা পরিচালিত হয়। দেখুন, ইবনে সিনা এখানে সমষ্টিগত জীবন, নগরায়ণ এবং সভ্যতাকে উচ্চতর নৈতিক ভিত্তির উপর স্থাপন করার জন্য ‘সুন্নাহ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এখানের ‘সুন্নাহ্’ শব্দটি এবং রাসূল (স)-এর সুন্নাহ শব্দ দুটি একই। রাসূল (স)-এর সুন্নাহ্ হলো এমন একটি সঠিক পথ যা বিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা ও সত্কাজের উপর ভিত্তি করে জীবন পরিচালনার রূপরেখা প্রদান করে।
ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি সঠিক পদ্ধতিতে মদীনায় একটি ইসলামী শহর গড়ে তোলেন। মদীনার মুসলিম শাসনের একদম শুরুর দিকের মুসলিম সমাজ সেখানে শুধু নগর জীবনের স্বাদ-ই পায়নি, বরং একটি সভ্যতার ভিতরে থাকার অভিজ্ঞতাও লাভ করেছিল। মদীনার এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যত্ ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি তৈরি করেছিল। আমরা আজ বৈশ্বিক যে দুর্যোগের মুখে আছি, সেখানে নগর জীবন এবং সভ্যতার এই অর্থগুলো আমাদের পুনরুদ্ধার করা উচিত।
৪
তরুণদের মধ্যে যারা ইসলাম নিয়ে ভাবছেন জোবায়ের আল মাহমুদ তাদের মধ্যে আমার অতি প্রিয়দের একজন। বাংলাদেশে আমাদের প্রচুর ভাবুক, তার্কিক ও ইতিহাসবিদ দরকার। বিশেষত যারা আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষা জানেন এবং বাংলায় লিখতে পারেন। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য ও আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হলে আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় ইসলাম সংক্রান্ত বইপত্র সরাসরি পড়তে পারার দক্ষতা এবং সেইসব লেখার কালোপযোগী ব্যাখ্যার হিম্মত তরুণদের অর্জন করা দরকার।
আল ফারাবি থেকে একটি বিক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি দেখে জোবায়েরের একটি স্টেটাসে আমি মন্তব্য প্রয়োজনীয় মনে করেছি। এই উদ্ধৃতিতে আল ফারাবিকে ভুল বোঝার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ফারাবি গ্রিক চিন্তার দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত ছিলেন। ফলে আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তায় উদ্বুদ্ধ লিবারেল রাজনৈতিক চিন্তার উপাদান তার মধ্যে থাকা খুবই স্বাভাবিক। উদ্ধৃতিটি ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করেছে, বাংলাদেশে পাশ্চাত্যের উদার রাজনৈতিক চিন্তার সপক্ষেই উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয়েছে। আমার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জোবায়ের বলছেন, 'ফারাবি কোনো ভাবেই গ্রিক অনুমান ও দর্শনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেননি'। এই দাবি তর্ক সাপেক্ষ। সেটা নাহয় আপাতত তোলা রইল। প্রশ্ন হচ্ছে যদি তাই হয় তাহলে জোবায়ের আধুনিক লিবারেল রাজনীতির সপক্ষে ফারাবির এই উদ্ধৃতি কোথায় পেলেন? আর কেনই বা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্ততায় ঠিক এই ধরণের উদ্ধৃতি দিলেন?
এতে আল ফারাবি সম্পর্কে পাঠক ভুল ধারণা পাবেন মনে করে একান্তই উদ্ধৃতিটি কেন্দ্র করেই আমি মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছি। বলাবাহুল্য, আমার মন্তব্য ফারাবির সমালোচনা ও পর্যালোচনা নয়। জোবায়ের এখন আল ফারাবি সম্পর্কে লিখছেন। সেটা ভাল। কিন্তু আমার মন্তব্য একান্তই পাশ্চাত্যের উদারবাদী চিন্তা ও রাজনীতি প্রসঙ্গে। আল ফারাবির মধ্যে যার উপাদান রয়েছে। পাশ্চাত্যের উদারবাদী চিন্তা ও রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সকল তরুণের কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
‘স্বাধীন অধিবাসী’দের নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা প্রাচীন ও পশ্চাতপদ। ব্যক্তি স্বাধীন এবং ব্যক্তির ইচ্ছা সার্বভৌম – আধুনিক গণতন্ত্রের এইসকল যারপরনাই ফালতু ও অন্তঃসারশূন্য কেচ্ছা বিশ্বাস করার কারণে এই ধরণের আজগবি রাষ্ট্রের চিন্তা আমরা করি। যখন টেলিভিশান বা মিডিয়াতে কোম্পানির বিজ্ঞাপন দৈনন্দিন আমাদের ইচ্ছা, কামনা ও বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করে আর অধিবাসীসকল করপোরেট বাণিজ্যের গোলামে পরিণত, সেখানে ব্যক্তি ‘স্বাধীন’ ও ‘সার্বভৌম’ কথাটা আধুনিক জীবনের বিকট অন্তঃসারশূন্যতা লুকাবার জন্যই ব্যবহার করা হয়।
এই লিবারেল মতাদর্শ একান্তই পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের অভিব্যক্তি। এই সমাজেই আমরা পরাধীন হয়েও নিজেদের ‘স্বাধীন’ ভাবি। এর ফলে ইসলাম যখন নিঃশর্ত আত্মসমর্পন’ কথাটা বলে, তখন তথাকথিত 'ব্যক্তি স্বাধীনতা'র বিরুদ্ধে ইসলাম দানব হিশাবে হাজির হয়। ইসলাম কেন কথাটা বলে তার মর্মে প্রবেশের তাগিদ শুরুতেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পন’ কথাকে ব্যাখা করা হয় অতিশয় হিংস্র, পশ্চাতপদ ও গণমানুষের দুষমণ এক শ্রেণির ক্ষমতাশালী আলেম ওলেমাদের ফতোয়ার কাছে আত্মসমর্পণ হিশাবে, অর্থাৎ ইসলাম হয়ে ওঠে এক প্রকার স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব বা অথরিটি, হয়ে ওঠে মানুষকে জিম্মি করবার জন্য ধর্মীয় পুরোহিতদের ধর্মীয়(?) মতাদর্শ।
আশা করব তরুণরা ফারাবিসহ মুসলমান দার্শনিকদের আরও মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করবেন, যাতে ফারাবির কালে গ্রিক চিন্তা ও ইসলামের টানাপড়েন ভাল ভাবে বোঝা যায়।
জোবায়ের উত্তর দিচ্ছেন, এতে আমি খুবই আনন্দিত। আশা করি আমরা একটি শক্তিশালী চিন্তার ধারা গড়ে তুলতে পারব যাতে বাংলাদেশে শক্তিশালী গণমানুষের রাজনৈতিক ধারার আবির্ভাব ত্বরান্বিত হয়।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10157368363420742&id=718000741