সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?”

এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি।

যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে।

১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি?
অথবা,
২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন?

এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।

উদাহরণ – এক।


বিশ্বজগতে আমরা যা কিছু দেখি, এবং যা কিছু চিন্তা করতে পারি, সবকিছুর দুটি দিক থাকে। একটি অংশ পূর্ব থেকে নির্ধারিত, এবং অন্য একটি অংশ পরিবর্তনশীল।

যেমন, ইচ্ছা করলে আপনি এ লেখাটা না পড়ে অন্য লেখায় চোখ বুলাতে পারেন। কিন্তু, ইচ্ছা করলেই চোখ বন্ধ করে নাক দিয়ে এই লেখাটা দেখতে পারবেন না। চোখ বন্ধ করে নাকের সাহায্যে কোনো কিছু দেখার চেষ্টা আপনি করতেই পারেন, কিন্তু মানুষের নাক দিয়ে কোনো কিছুই দেখা সম্ভব না। এই যে নাক দিয়ে মানুষ দেখতে পারে না, এটা আল্লাহ তায়ালা পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই মানুষ নাক দিয়ে কোনো কিছু দেখতে পারে না। আবার, চোখ দিয়ে যে মানুষ যা ইচ্ছা তা দেখতে পারে, এটাও আল্লাহ তায়ালা আগ থেকেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

এরপর ধরুন, আপনি ইচ্ছা করলেই আপনার হাতের মোবাইলটা বন্ধ বা চালু করতে পারেন। কিন্তু, আপনি ইচ্ছা করলেও মোবাইলের ব্যাটারিটা খুলে রেখে ঐ মোবাইলটি চালু করতে পারবেন না।

তারপর ধরুন, ফেইসবুকে আপনার যা ইচ্ছা তা পড়তে পারেন ও লিখতে পারেন। কিন্তু, ইচ্ছা করলেই মার্ক জুকারবার্গ ফেইসবুককে আপনি গুগল+ বানিয়ে ফেলতে পারবেন না। মার্ক জুকারবার্গ যে পদ্ধতিতে ফেইসবুক সাজিয়েছে, আপনাকে সে পদ্ধতি মেনে নিয়েই ফেইসবুক ব্যবহার করতে হবে।

বিশ্বের সবকিছুর এমন দুটি দিক আছে। সবকিছুর ক্ষেত্রেই একটু স্বাধীনতা দেয়া আছে, আবার পূর্ব নির্ধারিত একটি ফর্মুলাও দেয়া রয়েছে।

আমাদের জীবনের একটি ইচ্ছা শক্তি আছে, আবার আমাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। আমাদের ইচ্ছা শক্তি অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে পারে, আবার অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে পারে না। মানুষ কি পরিবর্তন করতে পারবে, এবং কতটুকু পরিবর্তন করতে পারবে, এটা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়। এই নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টাকে বিশ্বাস করার নাম-ই তাকদীর।

উদাহরণ – দুই।


প্রত্যেক মানুষের-ই কিছু না কিছু ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমে সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে। তবে, একটি ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে তার চেয়ে বড় অন্য একটি ক্ষমতা থাকে।

যেমন, একজন মন্ত্রী চাইলে দেশের জন্যে ভালো কিছু করতে পারে, সে ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা তার চেয়েও বেশি। প্রধানমন্ত্রী চাইলে মন্ত্রীর ক্ষমতাকে রোধ করতে পারে। অর্থাৎ, মন্ত্রীর ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অধীনে।

এরপর ধরুন, কোনো প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজার তার ক্যাশিয়ারকে টাকা গোনার ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু যে কোনো সময় ক্যাশিয়ারের সে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার যোগ্যতা ম্যানেজার রাখে। অর্থাৎ, ক্যাশিয়ারের ক্ষমতা ম্যানেজারের ক্ষমতার অধীনে। তেমনি, কোনো অফিসে কর্মচারীর ক্ষমতা তার কর্মকর্তার ক্ষমতার অধীনে।

ঠিক একইভাবে, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে কিছু না কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন, কিন্তু মানুষের সকল ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার অধীনে। এ বিশ্বাসের নামই ‘তকদীরে’ বিশ্বাস।

উদাহরণ – তিন।


আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কিছু ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন, আবার ইচ্ছার সীমাবদ্ধতাও দিয়েছেন। ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে আমাদের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন পারি ঠিক, কিন্তু আমাদের সেই ইচ্ছা শক্তি এবং ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

কল্পনা করুন, মহা সড়কের পাশে একটি পার্ক আছে। শহরের একটি পরিবার তাদের ৬ বছর বয়সী একটি বাচ্চাকে নিয়ে ঐ পার্কে হাঁটতে গেল। বাচ্চাটির আব্বু-আম্মু তাকে ঐ পার্কের ভিতরে খেলার অনুমতি দিল, কিন্তু রাস্তায় যেতে নিষেধ করল। বাচ্চাটি খেলেতে খেলতে যখনি রাস্তায় চলে যেতে লাগলো, তখনি তার আব্বু-আম্মু তাকে ধরে ফেলল। পার্কের ভিতরে যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীনতা বাচ্চাটির থাকলেও রাস্তায় যাবার স্বাধীনতা বাচ্চাটির নেই। কারণ, রাস্তায় গেলে বাচ্চাটি গাড়ির নিছে পড়বে।

এই যে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, এটা তকদীরের অন্তর্ভুক্ত। আমরা যা কিছু ইচ্ছা করি, সবকিছু করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা করার ক্ষমতা আল্লাহর আছে। –এটা বিশ্বাস করার নাম তাকদীর।

এবার মূল প্রশ্নে আসি – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?”

এই প্রশ্নটির মাঝে একটি শব্দ হলো – ‘পূর্ব’। ‘পূর্ব’ শব্দের অর্থ অতীত। মানে, ভাগ্য কি অতীতে থেকে নির্ধারিত থাকে?

‘অতীত’ শব্দটি সময়ের সাথে সম্পর্কিত। সময়কে মানুষ সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করে – অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। মানুষ সময়ের অধীন। সময়ের মাত্রা-জ্ঞান ব্যতীত মানুষ কোনো কিছু কল্পনা করতে পারে না। তাই, মানুষ প্রশ্ন করে, ভাগ্য কি ‘পূর্ব’ থেকে নির্ধারিত? কিন্তু, আল্লাহ সময়ের অধীন নয়, তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে। আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কাল বলে কিছু নেই। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলছেন –
وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلَّا كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর কাছেই রয়েছে। কিয়ামতের ব্যাপারটি তো চোখের পলকের ন্যায়, অথবা তার চাইতেও দ্রুত। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর কাদীর বা শক্তিমান। [সূরা ১৬ /নাহল – ৭৭]

তাকদীর বোঝার জন্যে এই আয়াতটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই আয়াতে তাকদীর সম্পর্কে বেশ কিছু অনুসিদ্ধান্ত রয়েছে। যেমন,

অনুসিদ্ধান্ত – এক।
আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিনে সবকিছুর গায়েব জানেন। এখানে গায়েব জানার অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা ভবিষ্যতের বিষয়াবলীকে ঠিক সেভাবেই জানেন, যেভাবে তিনি অতীতের বিষয়াবলীকে জানেন। অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার নিকট অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

অনুসিদ্ধান্ত – দুই।
আল্লাহ তায়ালা সময়ের অধীন নয়, তিনি সময়ের অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁর কাছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব একই। ফলে, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত এই সময়টা মানুষের কাছে হাজার হাজার মিলিয়ন বছর হলেও আল্লাহর কাছে একটি চোখের পলকের চেয়েও কম সময়। অর্থাৎ, আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এগুলো নেই।

বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিত বলি।

দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার মত ‘সময়’ও একটি মাত্রা। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ব্যতীত যেমন কোনো মানুষকে কল্পনা করা যায় না, তেমনি সময় ব্যতীতও কোনো মানুষকে কল্পনা করা যায় না। মানুষ যখন পৃথিবীতে আকৃতি লাভ করে, তখন সে একটি সময়ে প্রবেশ করে; আবার যখন মৃত্যু বরণ করে, তখন এই সময় থেকে বের হয়ে যায়। তাই, মানুষ সময়ের অধীন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার জন্ম ও মৃত্যু নেই, শুরু বা শেষ নেই।[সূত্র আল কোর’আন, ৫৭:৩]। তাই আল্লাহ তায়ালা সময়ের অধীন নয়, বরং সময়-ই আল্লাহ তায়ালার অধীন। মানুষের বর্তমান, অতীত বা ভবিষ্যৎ কাল আছে। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল বলে কিছু নেই। মানুষ সময়ের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহর কাছে সব কালই বর্তমান কাল।

অনুসিদ্ধান্ত – তিন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টিজগতের সবাইকে কিছু কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মালিক তিনি।

এ তিনটি অনুসিদ্ধান্তের পর আমরা বলতে পারি,

“আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের ভাগ্য ‘পূর্ব’ নির্ধারিত” –এ কথাটা কেবল মানুষের জন্যে প্রযোজ্য। আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ, মানুষের জন্যে যা অতীত, আল্লাহর জন্যে তা ‘অতীত’ নয়; আবার, মানুষের জন্যে যা ভবিষ্যৎ, তাও আল্লাহর জন্যে ‘ভবিষ্যৎ’ নয়। আল্লাহর নিকট অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবি এক। তিনি ভবিষ্যতকে অতীতের মতই জানেন। তিনি যখন মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন, তখন অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ বলে কোনো কিছু থাকে না। কিন্তু মানুষেরা যেহেতু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের মধ্যে থাকে, তাই মানুষকে বোঝানোর জন্যে রাসূল (স) বলেছেন যে, মানুষের ভাগ্য ‘অতীত’ বা ‘পূর্ব’ থেকেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে।

এবার, কোর’আন থেকে কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।

কোর’আনের উদাহরণ – ১


নিচের দুটি আয়াত দেখুন। প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, মানুষের উপর যে বিপদ আসে তা আগেই লিপিবদ্ধ করা থাকে। কিন্তু, দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, মানুষের কৃতকর্মের কারণেই তার উপর বিপদ আসে।
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍۢ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَا فِىٓ أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِى كِتَـٰبٍۢ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ ۚ إِنَّ ذَ‌ٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٌۭ

পৃথিবীতে এবং তোমাদের উপর যে বিপদ আসে, তা পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ করা আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। [ সূরা ৫৭/হাদীদ – ২২]

 

وَمَآ أَصَـٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٍۢ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُوا۟ عَن كَثِيرٍۢ

তোমাদের উপর যে বিপদ আসে, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। এবং তোমাদের অনেক গোনাহ তিনি ক্ষমা করে দেন। [ সূরা ৪২/শূরা – ৩০]

দেখে মনে হয়, আয়াত দুটি কি পরস্পর বিপরীত? উত্তর – না। একটু লক্ষ্য করলেই দেখব, মানুষ যখন কোনো কাজ করে, তখন সে কাজের একটি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ থাকে। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল একই।

তাই দেখুন, বিপদের ব্যাপারটা যখন আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত হয়েছে, তখন তিনি বলেছেন – বিপদ আসার আগেই তা আল্লাহ নিকট লেখা থাকে, এবং এটি আল্লাহর জন্যে খুবই সহজ একটি কাজ। কিন্তু, বিপদের ব্যাপারটা যখন মানুষের সাথে সম্পর্কিত হয়েছে, তখন আল্লাহ বলছেন – মানুষের কৃতকর্মের ফলেই বিপদ আসে। আল্লাহর ক্ষেত্রে সময় এবং মানুষের সময়, – দুটি বিষয়ের পার্থক্য মাথায় রাখলে আয়াত দুটির মাঝে কোনো বৈপরীত্য আর থাকে না।

কোর’আনের উদাহরণ – ২


এবার, অন্য দু’টি আয়াত দেখুন। প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন – ‘তিনি যদি চাইতেন তাহলে মানুষ ‘শিরক’ করতো না’। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলছেন – ‘মুশরিকরা বলছে, আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে মুশরিকরা শিরক করত না’।
وَلَوْ شَآءَ ٱللَّهُ مَآ أَشْرَكُوا۟ ۗ وَمَا جَعَلْنَـٰكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًۭا ۖ وَمَآ أَنتَ عَلَيْهِم بِوَكِيلٍۢ

যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে তারা শিরক করত না। আমি আপনাকে তাদের রক্ষক নিযুক্ত করিনি এবং আপনি তাদের কার্যনির্বাহী নন। [সূরা ৬/আনয়াম – ১০৭]

 

وَقَالَ ٱلَّذِينَ أَشْرَكُوا۟ لَوْ شَآءَ ٱللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِن دُونِهِۦ مِن شَىْءٍۢ نَّحْنُ وَلَآ ءَابَآؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِن دُونِهِۦ مِن شَىْءٍۢ ۚ كَذَ‌ٰلِكَ فَعَلَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ فَهَلْ عَلَى ٱلرُّسُلِ إِلَّا ٱلْبَلَـٰغُ ٱلْمُبِينُ

মুশরিকরা বলল: যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে আমরা ও আমাদের পিতৃপুরুষেরা তাঁকে ছাড়া অপর কারও ইবাদত করতাম না, এবং তাঁর নির্দেশ ছাড়া কোন বস্তুই আমরা হারাম করতাম না। তাদের পূর্ববর্তীরা এমনই করেছে। রাসূলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র সুস্পষ্ট বাণী পৌছিয়ে দেয়া।[ সূরা ১৬/নাহল – ৩৫]

লক্ষ্য করুন, দুটি আয়াতে একই কথা বলা হচ্ছে। প্রথম আয়াতে যে কথা বলে আল্লাহর ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে, অথচ দ্বিতীয় আয়াতে সে একই কথা বলেই মুশরিকদের অন্যায়ের কথা বলা হচ্ছে। তাহলে, আয়াত দুটি কি পরস্পর বিরোধী?

উত্তর – না।

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিরক করার ক্ষমতা দিয়েছেন বলেই মানুষ শিরক করতে পারে। কিন্তু, শিরক করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়ার অর্থ এই নয় যে, মানুষকে তিনি শিরক করার অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে চোখ দিয়ে দেখার ক্ষমতা দিয়েছেন, কিন্তু সবকিছু দেখার অনুমতি দেননি। অন্যদিকে, নাক দিয়ে দেখার ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দেননি, তাই আমরা শত চেষ্টা করলেও নাক দিয়ে কোনো কিছু দেখতে পারব না। সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সীমাবদ্ধ ক্ষমতার কারণেই আমরা করতে পারি। ভালো বা খারাপ যাই করি না কেন, সেই ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দিয়েছেন বলেই আমরা তা করতে পারি। তিনি তাঁর ক্ষমতা আমাদের থেকে কেড়ে নিলে, আমরা যেমন ভালো কোনো কাজও করতে পারব না, তেমনি খারাপ কোনো কাজও করতে পারব না।

এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। মানুষ যখন কোনো কিছু চায়, তখন তা সময়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মানুষ বর্তমানে কোনো কিছু চাইলে তা ভবিষ্যতে গিয়ে পরিপূর্ণ হয়। কিন্তু, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো কিছু ইচ্ছা করেন, তখন সেটি সময়ের অধীন হয় না। অর্থাৎ, যেহেতু তাঁর কাছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সক একই, তাই তিনি কোনো কিছু চাওয়া মাত্রই তা হয়ে যায়। তাই, আল্লাহর চাওয়া ও মানুষের চাওয়ার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে।

এ কারণেই, উপরোক্ত আয়াতে মুশরিকরা যখন দাবী করে – ‘আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমরা শিরক করেছি’ – তখন সেটি একটি ভ্রান্ত দাবীতে পরিণত হয়। অথচ, আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন – আমি চাইলে তারা কেউ শিরক করত না। এখানে, আল্লাহর চাওয়া এবং মানুষের চাওয়ার পার্থক্যটি বোঝা জরুরী।

কোর’আনের উদাহরণ – ৩


কোর’আনের আরো দুটি আয়াত দেখুন। এখানে প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, তাঁর জ্ঞান ব্যতীত একটি গাছের পাতাও ঝরে না। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে তিনি বলছেন, কোনো জাতি নিজেই তার ভাগ্য পরিবর্তন না করলে, আল্লাহ সে জাতীর ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন না।
وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَآ إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِى ٱلْبَرِّ وَٱلْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍۢ فِى ظُلُمَـٰتِ ٱلْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍۢ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِى كِتَـٰبٍۢ مُّبِينٍۢ

অদৃশ্য জগতের চাবি তাঁর কাছেই রয়েছে, এগুলো তিনি ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তা তিনি জানেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না, অথবা রসযুক্ত বা শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই। [সূরা ৬/আন’আম – ৫৯]
ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

এটি এজন্যে যে, আল্লাহ কখনও সে সব নেয়ামত পরিবর্তন করেন না, যা তিনি কোন জাতিকে দান করেছিলেন, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেই নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে নেয়। বস্তুত: আল্লাহ শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। [সূরা ৮/আনফাল – ৫৩]

প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে, গাছের একটি পাতাও আল্লাহর অজ্ঞাতসারে পড়ে না, সব আগে থেকেই কিতাবে লিখা আছে। আর, দ্বিতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে, মানুষ তার ভাগ্য পরিবর্তন না করলে আল্লাহ নিজ থেকে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন না। তাহলে আয়াত দুটি কি পরস্পর বিরোধী?

উপরের উদাহরণ দুটির মত এখানেও আল্লাহর ক্ষমতা ও মানুষের ক্ষমতার পার্থক্য বোঝা প্রয়োজন। প্রথম আয়াতে আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় আয়াতে মানুষের করণীয় ও মানুষের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে।

এখানে দ্বিতীয় আয়াতটি একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা আগ থেকেই মানুষকে কিছু নিয়ামত বা সুযোগ দিয়ে রেখেছেন। মানুষ যদি সে সুযোগ গ্রহণ করে, তাহলে তার ভাগ্য পরিবর্তন হবে। আর যদি সুযোগ গ্রহণ না করে, তাহলে সে বঞ্চিত হবে।

এখন, মানুষ আল্লাহর নিয়ামত গ্রহণ করবে নাকি বর্জন করবে, এটা আল্লাহর পক্ষে আগ থেকেই জানা সম্ভব। কারণ, মানুষের যেমন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল আছে, আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে এমন কোনো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল নেই। মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ কাল আল্লাহর জন্যে একই। তাই, মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আগ থেকেই জানেন।

বিষয়টি আরো সহজভাবে বলার জন্যে সর্বশেষ একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

ধরুন, তাজা ঘাসে পরিপূর্ণ একটি মাঠ। একজন রাখাল একটি গরুর গলায় রশি লাগিয়ে তাকে ঐ মাঠে ছেড়ে দিল। মাঠের নির্দিষ্ট অংশে ইচ্ছামত বিচরণ করার ক্ষমতা গরুটির আছে, যেখান থেকে ইচ্ছা সেখান থেকে খাবারের সুযোগও তার আছে। কিন্তু গরুর গলার রশি যতদূর যায়, তার বাইরে গিয়ে ঘাস খাওয়ার সুযোগ গরুটিকে দেয়া হয়নি। এখন, গরুটি ইচ্ছা করলে মাঠের নির্দিষ্ট অংশের তাজা ঘাসগুলো খেয়ে নিজের পেট পূর্ণ করতে পারে, অথবা কিছু না খেয়ে উপাস থাকতে পারে। রাখাল জোর করে ঐ গরুটিকে ঘাস খাইয়ে দিবে না।

এভাবে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কিছু নেয়ামত আগ থেকেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আমরা যদি চেষ্টা করি, তাহলে আল্লাহর ঐ নিয়ামত অর্জন করতে পারব; আর চেষ্টা না করলে, ঐ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হব।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। রাখাল যেহেতু মানুষ, তাই সে সময়ের দ্বারা অবদ্ধ। গরুটি ঘাস খাবে কি খাবে না, এটা রাখাল আগ থেকে জানে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যেহেতু সময়ের ঊর্ধ্বে, তাই তিনি আগ থেকে জানেন, মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া নেয়ামত গ্রহণ করবে কি করবে না।

অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা সময়ের ঊর্ধ্বে, তাই তিনি মানুষের ভবিষ্যৎ জানেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষের ভবিষ্যৎ জানেন বলে, মানুষ যদি ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের আশা ত্যাগ করে, তাহলে মানুষ ভবিষ্যতকে হারিয়ে ফেলবে। এটাই আল্লাহ তায়ালার সুন্নত। এবং এটার নামই তাকদীর।

সুতরাং, তাকদীর বা ভাগ্য হলো এমন একটি বিষয় যা আল্লাহর সামগ্রিক ইচ্ছা এবং মানুষের সীমাবদ্ধ ইচ্ছার দ্বারা পরিবর্তনশীল। এখানে আল্লাহর ইচ্ছা সময়ের অধীন নয়, কিন্তু মানুষের সময়ের অধীন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

What is The Ruling Regarding a Women Going to Hajj Without a Mahram?

Answered by Dr. Yusuf al-Qaradawi | Translated by Sister Marwa The original rule stipulated in shari’a that a woman is not to travel alone.  Rather, she has to be accompanied by her husband or any other mahram of hers.  This rule is supported by narrations of Bukhari and others that Ibn-Abbas (ra) said, that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel except with a mahram, and no man should visit her except in the presence of a mahram.” Abu-Hurairah related the following on behalf of the Prophet (pbuh), “It is not permissible for a woman who believes in Allah and the Last Day to travel for one day and night except with a mahram.” Abu-Sa’id reported that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel for two days except she is accompanied by her husband or a mahram.”