সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিজ্ঞানে মুসলিমদের ঐতিহ্য ও ‘নিল ডিগ্রেস টাইসন’-এর মিথ্যাচার

বিজ্ঞানের জগতে এমন কেউ নেই, যিনি ‘নিল ডিগ্রেস টাইসন’কে চিনেন না। টাইসন একজন মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী, বিশ্বতাত্ত্বিক, অনেকগুলো বেস্টসেলার বইয়ের লেখক এবং জনপ্রিয় বক্তা।

তিনি প্রায়ই ইসলাম নিয়ে কথা বলেন। খুব দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন যে, মুসলিমরা এক সময়ে বিজ্ঞানে অনেক উন্নত ছিলো, কিন্তু আজ মুসলিমদের কেন এই দুর্দশা?

বিজ্ঞানী টাইসনের একটি ভিডিও এখানে যুক্ত করে দিয়েছি, যেখানে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কেন মুসলিমদের আজ এই দুর্দশা। প্রথমে আসুন, তাঁর সেই ভিডিওতে তিনি কি বলেছিলেন, তা একটু সংক্ষেপে তুলে ধরি।

https://www.youtube.com/watch?v=08sBrXM0u4Q

বিজ্ঞানী টাইসন বলেন –

“আমরা আকাশে যে নক্ষত্র ও তারাগুলো দেখছি, সেগুলোর মধ্যে অসংখ্য তারকার নাম আরবিতে, এবং মুসলিমরাই এগুলো আবিষ্কার করেছিলেন, এবং তাঁরাই এগুলোর নাম দিয়েছিলেন।

গণিতে শাস্ত্রে আমরা এখন যে আল-জেবরা (Algebra - বীজগণিত) শব্দটি ব্যবহার করি, এটি একটি আরবি শব্দ। অথবা, কম্পিউটারের জন্যে আমরা যে অ্যালগরিদম (Algorithm) পরিভাষাটি ব্যবহার করি, এটিও একটি আরবি শব্দ এবং এগুলো মুসলিমদের-ই আবিষ্কার।

আমরা যে 1, 2, 3, এসব নম্বর ব্যবহার করি, সেটিও আরবি নম্বর থেকে এসেছে।

কেবল গণিত বা জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, রসায়ন, পদার্থ, কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, এমনকি আধুনিক সময়ের ন্যাভিগেশন সহ বিজ্ঞানের সকল শাস্ত্রে তখন এককভাবে মুসলিমদের-ই অবদান ছিলো।

মুসলিমদের বিজ্ঞানে উন্নতির সময়টা ছিলো ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যা কেবল মুসলিমদের জন্যে নয়, বরং সমস্ত মানব জাতীর জন্যে ছিলো একটি সোনালি যুগ। কিন্তু, ১১০০ শতাব্দীর পরে মুসলিমরা তাঁদের সকল বৈজ্ঞানিক অর্জনকে হারিয়ে ফেলেছে।

মুসলিমদের এই পতনের উদাহরণ দিতে গিয়ে বিজ্ঞানী টাইসন ১৯০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মুসলিম ও ইহুদীদের একটি পরিসংখ্যান দেখান।

পৃথিবীতে ইহুদীদের জনসংখ্যা মোট ১৫ মিলিয়ন। কিন্তু তাঁদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংখ্যা হলো:

বায়োমেডিক্যাল – ৪৯/ ১৯৬

রসায়ন – ২৮/ ১৫৮

পদার্থবিদ্যা – ৪৫/ ১৮৯

অর্থনীতিতে ২৮/ ৬৬

= মোট ৬০৯ টি নোবেল পুরস্কারের মাঝে ইহুদিরা পেয়েছে ১৫০ টি পুরষ্কার।

অর্থাৎ, ইহুদিরা নোবেল পুরস্কারের ২৫% পেয়েছে।

অন্যদিকে, মুসলিমদের ক্ষেত্রে দেখুন –

পৃথিবীতে মুসলিমদের জনসংখ্যা মোট ১.৩ বিলিয়ন। কিন্তু তাঁদের নোবেল পুরস্কারের সংখ্যা হলো:

বায়োমেডিক্যাল – ০/ ১৯৬

রসায়ন – ১/ ১৫৮

পদার্থবিদ্যা – ১/ ১৮৯

অর্থনীতিতে –২/ ৬৬

= মোট ৬০৯ টি নোবেল পুরস্কারের মাঝে মুসলিমরা পেয়েছে ৪ টি পুরষ্কার।

অর্থাৎ, মুসলিমরা নোবেল পুরস্কারের ০.৫০% পেয়েছে।

 

বিজ্ঞানী টাইসন মুসলিমদের এই পতনের কারণে একজন ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করেন। তিনি হলেন ইমাম আবু হামিদ আল গাজালী। ১১০০ সালের দিকে ইমাম গাজালী নাকি বলেছেন – “The manipulation of numbers is the work of the devil.” অর্থাৎ, “সংখ্যা নিয়ে কাজ করা হলো শয়তানের কাজ।”

ইমাম গাজালি এটা বলার পর নাকি মুসলিমরা বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়েছিলো, এবং এতে করে নাকি মুসলিমদের পতন শুরু হয়েছিলো।

বিজ্ঞানী টাইসনের উপরের কথাগুলো মোটামুটি ঠিক থাকলেও শেষে এসে তিনি মুসলিমদের পতনের যে কারণটি দেখিয়েছেন, তা একেবারেই সত্য নয়। আমার এ লিখার উদ্দেশ্য হলো টাইসনের ভুলগুলো দেখিয়ে দেয়া।

ইমাম গাজালী কখনো কোথাও বলেননি যে, “গণিত নিয়ে গবেষণা করাটা হলো শয়তানের কাজ”। বরং, ইমাম গাজালী তাঁর এহইয়া উলুমিদ্দিন বইয়ের জ্ঞান অধ্যায়ে বলেছেন –

“As for the praiseworthy disciplines such as medicine and mathematics they are associated with worldly benefit and that category is divided into those that become a communal obligation.”

[Al Ghazali, The Book of Knowledge: Book 1 of The Revival of the Religious Sciences by‎ Kenneth Honerkamp (Translator), p.38]

অর্থাৎ, গণিত ও ডাক্তারি বিদ্যার মতো যেসব জ্ঞান পৃথিবীর জন্যে কল্যাণকর, তা অর্জন করা ফরজে কিফায়া। সমাজের কাউকে না কাউকে এসব জ্ঞান অর্জন করাটা আবশ্যিক।

অনেকে বলেন, ইমাম গাজালী নাকি “দার্শনিকদের ভ্রান্তি” বইয়ে গণিত ও বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে এটাও একটি মিথ্যা অভিযোগ। বরং ইমাম গাজালী তাঁর সে বইয়ে গণিত, জ্যামিতি ও বিজ্ঞানের পক্ষে কথা বলেছেন।

ইমাম গাজালি বলেন –

“Regarding mathematical sciences, there is no sense in denying them or disagreeing with them [the philosophers] for these reduce in the final analysis to arithmetic and geometry.”

[Al Ghazali, The incoherence of the philosophers, translated by Maichael Marmura, Brigham Yong University (2000), p.11]

এখানে ইমাম গাজালি বলেছেন যে, গণিত ও জ্যামিতির সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে দার্শনিকদেরকে অস্বীকার করা বা তাঁদের সাথে দ্বিমত করার কোনো মানে নেই। ইমাম গাজালী কখনোই গণিত কিংবা বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেননি, বরং দার্শনিকদের কিছু ভ্রান্তির বিপরীতে তিনি দর্শনের এই বইটি লিখেছিলেন।

সুতরাং, বিজ্ঞানী টাইসন মুসলিমদের পতনের কারণ হিসাবে যে ইমাম গাজালিকে দায়ী করেছেন, তা আসলে একেবারেই ভুল ও ভিত্তিহীন।

এবার, বিজ্ঞানী টাইসনের অন্য একটি কথার জবাব দেয়া যাক। তিনি বলেছেন, ১১০০ সালের পর থেকে বিজ্ঞানে মুসলিমদের আর কোনো অবদান নেই। কিন্তু তাঁর এ কথাটিও সঠিক নয়।

বিজ্ঞানের ইতিহাস যারা জানেন, তাঁরা সহজেই বলতে পারেন, ১৩০০ সাল থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত সময়টিতে মুসলিমদের বিজ্ঞান চর্চা হতো মেরাগে এবং সমরকান্দে। তখনো মুসলিমরা অসংখ্য তারকা ও নক্ষত্র আবিষ্কার করেছিলো, এবং সেগুলোর নামও আরবিতে ছিলো। প্রকৃত অর্থে এই সময়টাতেই ছিলো জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলিমদের সোনালী যুগ। এছাড়া, উসমানী খিলাফতের সময়ে মুসলিমরা বিজ্ঞান ও টেকনোলোজিতে প্রচুর অবদান রেখেছিলেন।

ইমাম গাজালির মৃত্যুর পর ওমর খৈয়াম (মৃত্যু ১১৩১) বীজগণিতের একটি বই লিখেছিলেন, যে বইটি কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো।

এরপর, নাসির উদ্দিন তুসীর মৃত্যু ১২৭৪ সালে। তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান নিয়ে তিনি প্রায় ১২৫ টি বই লিখেছিলেন। পাঁচটি বই লিখেছেন কেবল গণিত নিয়েই। ১৬০০ সাল পর্যন্ত তাঁর বইগুলো বিভিন্ন মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো।

তারপর, আলি আল কুশজী (মৃত্যু ১৪৭৪) ছিলেন উসমানী খিলাফতের একজন বিজ্ঞানী। তাঁর একটি গণিতের বই ও একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই ১৬৫০ সালে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ হয়েছিলো। এবং সে বইগুলো তখন ইউরোপে পড়ানো হতো।

এভাবে ১৮০০ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম বিজ্ঞানীদের অসংখ্য নাম উল্লেখ করা যাবে, যারা বিজ্ঞান ও গনিতে বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮০০ শতাব্দীর পর থেকে যখন ফ্রান্স ও ব্রিটিশরা যখন মুসলিমদের ভৌগলিক অঞ্চলগুলো দখন করতে শুরু করলো, তখন থেকেই মুসলিমরা জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার আর তেমন কোনো সুযোগ পায়নি।

বিজ্ঞানী টাইসন যেভাবে বলেছেন, ১১০০ শতাব্দীর পরেই বিজ্ঞান ও গণিতে মুসলিমদের পতন শুরু হয়, এটাও আসলে সঠিক নয়। বিজ্ঞানে মুসলিমদের পতন শুরু হয় ১৮০০ শতাব্দীর পর থেকে, যখন মুসলিমদের ভৌগলিক অঞ্চলগুলো ইউরোপ দখল করে বা কলোনি করে নিয়েছিলো।

বিজ্ঞানী নিল ডিগ্রেস টাইসন [Neil deGrasse Tyson] এর উদ্দেশ্য হয়তো ভালো ছিলো, কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার কারণে তিনি উপরোক্ত ভুল বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। টাইসনের মতো অনেক মুসলিমও না বুঝেই ইমাম গাজালিকে অভিযুক্ত করেন।

কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, ইউরোপ ও অ্যামেরিকা নিজেদের দোষ অন্যের গাঁড়ে ছাপিয়ে দেয়ার জন্যেই বলে থাকে যে, ইমাম গাজালির কারণে বিজ্ঞান ও গনিতে মুসলিমদের পতন হয়েছে। আসলে, আসলে দখলকারী ইউরোপের কারণেই মুসলিমদের স্বাভাবিক জ্ঞান অর্জনে ব্যাঘাত ঘটেছে। এবং এ কারণেই ১৯০০ সাল থেকে মুসলিম বিজ্ঞানীদেরকে নোবেল পুরস্কারে কোনো অধিকার দেয়া হচ্ছে না।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

What is The Ruling Regarding a Women Going to Hajj Without a Mahram?

Answered by Dr. Yusuf al-Qaradawi | Translated by Sister Marwa The original rule stipulated in shari’a that a woman is not to travel alone.  Rather, she has to be accompanied by her husband or any other mahram of hers.  This rule is supported by narrations of Bukhari and others that Ibn-Abbas (ra) said, that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel except with a mahram, and no man should visit her except in the presence of a mahram.” Abu-Hurairah related the following on behalf of the Prophet (pbuh), “It is not permissible for a woman who believes in Allah and the Last Day to travel for one day and night except with a mahram.” Abu-Sa’id reported that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel for two days except she is accompanied by her husband or a mahram.”