সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসলামে জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়

গুগলের মতো যিনি অনেক তথ্য জানেন, তিনি জ্ঞানী নন। কিংবা যিনি অনেক কোর’আন হাদিস মুখস্থ পারেন, তিনি আলিম নন। জ্ঞানী হলেন তিনি, যিনি বিভিন্ন তথ্যকে নিজের জীবনে কাজে লাগান। অথবা, আলিম হলেন তিনি, যিনি কোর’আন ও হাদিসকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেন।

উদাহরণ স্বরূপ,

একজন লোক জানে, সিগারেট খাওয়া অনেক ক্ষতি, কিন্তু তিনি সিগারেট ছাড়তে পারেন না। তাহলে এই জানার কারণেই তার শরীর সুস্থ হয়ে যাবে না। তেমনি কেউ কোনো তথ্য জানলেও তা যদি নিজের জীবনে কাজে লাগাতে না পারে, তাহলে তিনি জ্ঞানী হতে পারেন না। তেমনি কেউ যতই কোর'আন হাদিস মুখস্থ করুক, নিজের জীবনে কাজে না লাগাতে পারলে তিনিও আলিম হতে পারেন না।


অথবা ধরুন, একজন মানুষ জানে, নামাজ কিভাবে পড়তে হয়। কিন্তু তিনি যদি নামাজ না পড়েন, তাহলে এই জানাটা তার কোনো কাজে আসে না।

অর্থাৎ,

আমরা কত বড় জ্ঞানী, তা আল্লাহ আমাদেরকে জিজ্ঞাস করবেন না, আমরা কতটা ভালো কাজ করতে পেরেছি, তা আল্লাহ আমাদের জিজ্ঞেস করবেন।


__________

ইসলাম একটি আন্দোলন ও কর্মমুখী ধর্ম। অলসভাবে বসে বা শুয়ে থাকার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।

কোর’আনের প্রথম আদেশ হলো – “পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেন।” [৯৬/১]

আর, দ্বিতীয় আদেশ হলো – “হে! কম্বল মুড়িয়ে থাকা ব্যক্তি! উঠে দাঁড়াও এবং সতর্ক করো” [৭৪/১-২]


প্রথম আদেশে সৃজনশীল প্রভুর নামে জ্ঞান অর্জন করতে বলা হয়েছে, যাতে পৃথিবীতে আমরাও সৃজনশীল কিছু তৈরি করতে পারি। এরপর, দ্বিতীয় আদেশে শরীরে জড়িয়ে রাখা কম্বলটি ফেলে দিতে বলা হয়েছে, এবং উঠে দাঁড়াতে বলা হয়েছে।

কোর’আনে যত স্থানে জ্ঞানগত ঈমানের কথা বলা হয়েছে, ততস্থানেই কর্ম বা আমলের কথা বলা হয়েছে।

وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ

“আপনি তাদেরকে সুসংবাদ দিন, যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে। নিশ্চয় তাঁদের জন্যে রয়েছে এমন জান্নাত, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবহমান থাকবে”। [সূরা বাকারা - ২৫]

ঈমান মানুষের জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত, আর আমল মানুষের কর্মের সাথে সম্পর্কিত। ইসলামের জ্ঞান ও কর্ম একইসাথে চলে। জ্ঞান ছাড়া যেমন কর্ম বৃথা, তেমনি কর্ম ছাড়াও জ্ঞান বৃথা।

সহজে বুঝার জন্যে আমরা একটি ট্রেনকে কল্পনা করতে পারি। ধরুন, ট্রেনটির নাম ইসলাম। দুটি লাইনের উপর ভর করে ইসলাম নামক ট্রেনটি সামনে চলতে পারে। এখানে একটি লাইনের নাম হলো ঈমান বা জ্ঞান, এবং অপর লাইনটির নাম হলো কর্ম। ট্রেনটি সামনে চলতে হলো দুটি লাইন-ই পাশাপাশি থাকতে হয়। কেবল একটিমাত্র লাইনের উপর ভর করে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। যে কোনো একটি লাইন বিচ্যুত হলেই ট্রেনটি এক্সিডেন্ট করে। তেমনি, জ্ঞান ও কর্ম যে কোনো একটি লাইন থেকে কারো ইসলাম যখন বিচ্যুত হয়ে যায়, তখন তাঁর ধর্ম অচল হয়ে যায়।
__________

আল কোর’আনে ‘জ্ঞান’ শব্দটির জন্যে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো ইলম [علم]। এখানে তিনটি অক্ষর রয়েছে [ع - ل - م]। অন্যদিকে ‘কাজ’ শব্দটি বুঝানোর জন্যে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো আমল [عمل]। এখানে তিনটি অক্ষর রয়েছে – [ع - م - ل] ।

অর্থাৎ, 'ইলম' ও 'আমল' শব্দ দুটি একই শব্দমূল থেকে এসেছে। কোর'আনের ভাষায়, জ্ঞান ও কর্ম একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ঠিক ট্রেনের দুটি লাইনের মতোই।

কেবল জ্ঞানের জন্যে জ্ঞান, (knowledge for sake of knowledge) অথবা শিল্পের জন্যে শিল্প (art for art’s sake) – এই ধারণাগুলো ইসলামে নেই। ইসলামে ‘জ্ঞান’ ও ‘কাজ’ দুটি বিষয় পরস্পর দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ কারণেই মুসলিম দার্শনিক আল্লামা ইকবাল তাঁর “The reconstruction of religious thought in islam” বইয়ের শুরুতেই বলেছিলেন – “The Qur'an is a book which emphasizes deed rather than idea.”

ইসলামের প্রতিটি কাজ যেমন জ্ঞানের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তেমনি প্রতিটি জ্ঞান-ও কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিগত ও সামাজিক কল্যাণে যে জ্ঞান প্রয়োগ করা যায় না, ইসলাম তাকে জ্ঞান হিসাবে স্বীকার করে না। একইভাবে, ঈমানহীন বা জ্ঞানহীন কাজের কোনো মূল্য ইসলামে নেই।

থিউরি ও প্র্যাকটিসকে সমানভাবে মূল্য দেয় ইসলাম। অনেকেই ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক থিউরিকে অনেক গুরুত্ব দিলেও ইসলামের আন্দোলনকে মোটেও গুরুত্ব দেন না। আবার, অনেকেই ইসলামী আন্দোলনকে অনেক গুরুত্ব দিলেও ইসলামী জ্ঞান বা থিউরিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। এদের উভয়ের উদাহরণ হলো ঐ ট্রেনটির মতো, যা একটি লাইন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।

সুতরাং, ইসলাম হচ্ছে একটি আন্দোলন ও কর্মমুখী ধর্মের নাম। এখানে জ্ঞান ও কর্ম সমান্তরালভাবে চলে। ঈমান বা জ্ঞান ছাড়া কর্ম সফল হতে পারে না, তেমনি কর্ম ছাড়াও জ্ঞান সার্থক হতে পারে না।

 


 

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

মাথায় রুমাল দেয়া কি মাদানী হুজুর হবার লক্ষণ? নাকি ইহুদি হবার লক্ষণ?

এক তথাকথিত সালাফী মাদানী হুজুর নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে ভ্রান্ত মনে করেন। অথচ, নিজেই ইহুদিদের মতো মাথায় রুমাল দিয়ে ওয়াজ করেন। মাথায় রুমাল দেয়ার বিরুদ্ধে যেসব সহীহ হাদিস আছে, তা কি তিনি দেখননি? দলীল – ১ يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ দাজ্জালের বাহিনীতে ৭০ হাজার ইহুদী থাকবে, যাদের মাথায় চাদর বা রুমাল থাকবে। সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৯৪৪ দলীল – ২ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَعِيدٍ الخُزَاعِيُّ، حَدَّثَنَا زِيَادُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ، قَالَ: نَظَرَ أَنَسٌ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَرَأَى طَيَالِسَةً، فَقَالَ: «كَأَنَّهُمُ السَّاعَةَ يَهُودُ خَيْبَرَ» আনাস ইবনু মালিক (রা) জুমার দিনে মসজিদের মধ্যে সমবেত মানুষের দিকে তাকালেন। তিনি অনেকের মাথায় রুমাল দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এরা এখনো ঠিক খাইবারের ইহুদীদের মত। সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ৪২০৮ দলীল – ৩ قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : ” قال لقمان لابنه وهو يعظه : يا بني إياك والتقنع ، فإنها مخوفة بالليل مذلة بالنهار রাসূল (স) ...

আহলে কোর'আনের কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব - ২

মোহাম্মদ Junaid ভাইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর। ১) ইমামদেরকে standard মানতে হবে কেন? - ইমামদেরকে আমরা প্লেটো বা এরিস্টটলের মতো জ্ঞানী, স্কলার ও আলেম মনে করি, standard নয়। ২) ওনাদের status কী? - পৃথিবীর হাজার হাজার স্কলারের মাঝে ইমামরাও অন্তর্ভুক্ত। ৩) ওনাদের কি সুসংবদ্ধ চিন্তা ছিল? - জ্বী, উনাদের কাজ-ই ছিলো চিন্তাকে ফ্রেম দেওয়া। ৪) ওনাদের রচনাসমগ্ৰ কি সুলভ? - দুর্ভাগ্য আমাদের। বাংলা ভাষায় উনাদের বই পুস্তক অনুবাদ হয়নি। কিন্তু, উনাদের প্রচুর বই আছে, যা আমরা জানি না। ৫) প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত? - জী। ৬) বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তো প্রবহমান নদীর মতো। পুরা যুগের কারো পায়রবিতে আটকে থাকতে হবে কেন? - নদী যেমন তার উৎসের সাথে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না, তেমনি আমরাও আমাদের অতীতের সকল জ্ঞানের উৎসের সাথে বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না। বরং আমাদের জ্ঞানের উৎসে যাবার রাস্তা খোলা রাখতে চাই। ৭) জ্ঞানের পরিমাপক কী? - একজন মানুষ তার সময়ের কতগুলো সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছেন, সেটাই তার জ্ঞানের পরিমাপক। ৮) ওনারা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব গ্ৰহণ করবেন? - অবশ্যই না। তবে, পৃথিবীকে জানা...