সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভাস্কর্য এবং মূর্তির পার্থক্য

এক

ভাস্কর্য এবং মূর্তির মাঝে অনেক বড় পার্থক্য আছে। ভাস্কর্য হলো সুন্দরের প্রতীক, কিন্তু মূর্তি হলো চেতনার প্রতীক।

থেমিসের জন্যে যারা কান্নাকাটি করছে, তারা থেমিসকে সুন্দরের প্রতীক মনে না করে বরং চেতনার প্রতীক মনে করে।

প্রশ্ন হলো, ইসলাম ভাস্কর্যকে সমর্থন করলেও মূর্তিকে সমর্থন করে না কেন?


কারণ হলো, কোনো অচেতন বস্তু কখনো কোনো চেতনার প্রতীক হতে পারে না।

পৃথিবীতে মানুষ উন্নত চেতনার অধিকারী, এবং পাথর নিম্ন চেতনার অধিকারী। উন্নত চেতনার মানুষ যখন নিম্ন চেতনার পাথরকে তার চেতনার প্রতীক মনে করে, তখন মানুষের চেতনা নিম্নগামী হতে শুরু করে।

মানুষ যখন তার চেতনার স্তর থেকে নিম্ন বস্তুর স্তরে নামতে শুরু করে, তখন মানুষ পশু হয়ে যায়। এভাবে কেউ যদি পশুর স্তর থেকে আরো নিচে নামতে শুরু করে, তাহলে সে একসময় অচেতন বস্তুর মত হয়ে যায়।

পৃথিবীতে মানুষের কাজ হলো বিশ্বের সর্বোচ্চ চেতনার সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করা। ধার্মিক মানুষেরা এ কাজটি তাদের সালাত ও সাওমের মাধ্যমে পালন করার চেষ্টা করে।

কিন্তু যারা অচেতন বস্তুকে তাদের চেতনার প্রতীক মনে করে, তারা প্রকৃতির বিপরীতে চলতে চায়। এর ফলে তারা মানুষের চেতনার স্তর থেকে বস্তুর স্তরে নেমে যায়। তাই, কোর’আনে এদেরকে পশু বলা হয়েছে।

দুই

মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্যটা কাঠামোগত নয়, বরং চেতনাগত। কোনো কিছুকে চেতনার প্রতীক মনে করলে, তার কাঠামো যাই হোক না কেন, সেটা মূর্তি। অন্যদিকে, কোনো কিছুকে সুন্দরের প্রতীক মনে করলে, এবং তার কাঠামো যদি নোংরা না হয়, তাহলে তা ভাস্কর্য।

কোর’আন থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।

ইব্রাহীম (আ) –এর সময়ে মানুষেরা কিছু প্রতিকৃতিকে তাদের পূর্বপুরুষের চেতনা ও বিশ্বাসের প্রতীক মনে করত। কিন্তু, অচেতন বস্তু যেহেতু মানুষের বিশ্বাস বা চেতনার প্রতীক হতে পারে না, তাই ইব্রাহীম (আ) তাদের সেই প্রতিকৃতিগুলো ভেঙ্গে দিয়েছিল।


إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِۦ مَا هَـٰذِهِ ٱلتَّمَاثِيلُ ٱلَّتِىٓ أَنتُمْ لَهَا عَـٰكِفُونَ قَالُوا۟ وَجَدْنَآ ءَابَآءَنَا لَهَا عَـٰبِدِينَ

"যখন ইব্রাহীম তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, এই প্রতিকৃতিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ। তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে এদের পুজা করতে দেখেছি"। [সূরা ২১/আম্বিয়া - ৫২ ও ৫৩]

এরপর,

ইব্রাহীম (আ) অনেক পর সোলায়মান (আ) পৃথিবীতে আসলেন। তার সময়ে তাওহীদের ধারনাটা মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল। প্রতিকৃতিকে মানুষ তখন সৌন্দর্যের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করত। ফলে, সোলায়মান (আ) নিজেই প্রতিকৃতি তৈরি করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

يَعْمَلُونَ لَهُۥ مَا يَشَآءُ مِن مَّحَـٰرِيبَ وَتَمَـٰثِيلَ وَجِفَانٍۢ كَٱلْجَوَابِ وَقُدُورٍۢ رَّاسِيَـٰتٍ ۚ ٱعْمَلُوٓا۟ ءَالَ دَاوُۥدَ شُكْرًۭا ۚ وَقَلِيلٌۭ مِّنْ عِبَادِىَ ٱلشَّكُورُ

"তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।" [সূরা ৩৪/সাবা - ১৩]
_________
কোর’আনে বর্ণিত সকল নবীর ঘটনা ও কাজের সমষ্টি-ই হলো ইসলাম। ইসলামে মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্যটা কাঠামোগত নয়, বরং চেতনাগত।
_________

একটি প্রতিকৃতিকে কেউ যখন বাচ্চার খেলনার মত মনে করবে, অথবা সৌন্দর্যের কোনো কাজে ব্যবহার করবে, তখন তা ভাস্কর্য হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু একই প্রতিকৃতিকে কেউ যদি তার চেতনা ও বিশ্বাসের প্রতীক মনে করে, তখন তা মূর্তি হিসাবে গণ্য হবে।

একইভাবে দেখুন,

ইব্রাহীম (আ)-এর সময়ে মানুষ চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রকে তাদের চেতনা ও বিশ্বাসের প্রতীক মনে করায় তা শিরক হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে কেউ যদি চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করে, তাহলে তা শিরক হবে না।

শুধু পাথরের মূর্তি নয়, কোর'আনের বর্ণনা অনুযায়ী, মানুষ তার নিজের শরীর ও সম্পদের দ্বারাও শিরক করে। মানুষ যখন নিজের শরীর ও নিজের অর্জিত সম্পদকে খুব বেশি ভালোবাসতে শুরু করে, তখন তার শরীর ও সম্পদও শিরকের উপাদান বা মূর্তি হয়ে যায়। [সূত্র ২: ৯৬, ১৮: ৪২]

সুতরাং, কেবল কাঠামোগত বাইরের কোনো প্রতিকৃতির মধ্যে নয়, বরং মানুষের চিন্তার মধ্যেই শিরক থাকে। মানুষের চিন্তা ও চেতনার অঙ্গনেই শিরকের অসংখ্য মূর্তি গড়ে উঠে। আমরা বাইরের প্রতিকৃতি নিয়ে খুব সোচ্চার হলেও, ভিতরের মূর্তিগুলো দেখতে পাই না।



 

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

গণতন্ত্র সময়ের একটি চাহিদা

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনের কথা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? ধরুন, ১৬১৭ সাল। উসমানী খেলাফতের অধীনে তখন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ ভূমি। সেই এক-তৃতীয়াংশ ভূমির খেলাফতের দায়িত্ব পালন করছেন সুলতান আহমদ। কেউ যদি তখন বলতো, আমরা সুলতান আহমদের পরিবর্তন চাই এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। তাহলে তখন কিভাবে সে নির্বাচনটি হত? তখন তো আর ইন্টারনেট বা টেলিভিশন ছিল না, এমনকি প্লেনও ছিল না। নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচনী তফসিলটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রত্যেকের কাছে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে করতে কমপক্ষে ৩ বছর সময় লেগে যেতো। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকল মানুষ যেহেতু খলীফা প্রার্থী হবার অধিকার রাখে, সুতরাং নির্বাচন কমিশনারের কাছে তাঁদের মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে করতে সময় লাগতো আরো ২ বছর। নির্বাচন কমিশনার লক্ষ লক্ষ মনোনয়ন পত্র বাচাই করতে করতে লাগতো আরো ১ বছর। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের এবং আপিল নিষ্পত্তি করতে সময় লাগতো কমপক্ষে আরো ৫ বছর। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার সময় দিতে হতো কমপক্ষে আরো ১ বছর। কারণ প্রার্থীদেরকে বহুদূর থেকে এসে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হতো। তারপর, প্রা...