সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বুদ্ধিজীবীদের সাথে রাজনৈতিকদের পার্থক্য - ইবনে খালদুন

মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাজ নয়, এটা আলেম-ওলামা ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাজ দেশের মানুষকে একতাবদ্ধ রাখা, আর আলেম-ওলামাদের কাজ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা, এবং মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া।

রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যখন মানুষকে নৈতিকতা শিখাতে চান, তখন তাঁরা ব্যর্থ হন। একইভাবে আলেম ও বুদ্ধিজীবীরা যখন রাজনীতি করতে চান, তখন তারাও ব্যর্থ হন। এ সূত্রটি দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন।

ইবনে খালদুন বলেন -

أن العلماء من بين البشر أبعد عن السياسة ومذاهبها

"নিশ্চয় আলেম-ওলামা বা বুদ্ধিজীবীরা মানব সমাজের রাজনীতি ও বিভিন্ন দল-উপদল থেকে দূরে থাকেন।"

ইবনে খালদুনের মতে, আলেমরা সাধারণত সবসময়ে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করতে ব্যস্ত থাকেন। কে তাঁদের কথা মেনে নিলো, আর কে তাঁদের কথা মেনে নিলো না, তা আলেমগণ পরোয়া করেন না। কিন্তু এমন আচরণ রাজনীতির ক্ষেত্রে খাটে না। রাজনীতির মাঠে সবাইকে সংঘবদ্ধ করে সামনে চলতে হয়।

আলেম-ওলামা ও বুদ্ধিজীবীগণ সবকিছুতে তাঁদের যুক্তি-বুদ্ধি, ইতিহাসের জ্ঞান ও তত্ত্ব ব্যবহার করতে চান। কিন্তু, সাধারণ মানুষ ইতিহাস জানে না, তাঁদের কোনো তত্ত্ব জ্ঞান নেই। তাই যুক্তি-বুদ্ধি, ইতিহাসের জ্ঞান বা কোনো তত্ত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষকে সবসময় বুঝানো যায় না।

এ কারণে আলেম-ওলামা বা বুদ্ধিজীবীরা যখন রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হন, তখন তাঁরা নানা কারণে ব্যর্থ হন। ইবনে খালদুন বলেন -

فتكون العلماء، لأجل ما تعودوه من تعميم الأحكام وقياس الأمور بعضها على بعض، إذا نظروا في السياسة، أفرغوا ذلك في قالب أنظارهم ونوع استدلالاتهم فيقعون في الغلط كثيراً ولا يؤمن عليهم
[مقدمة ابن خلدون ص: 348، بترقيم الشاملة آليا]

"আলেম-ওলামা বা বুদ্ধিজীবীগণ তত্ত্ব নির্ভর চিন্তা করতে এবং এক বিষয়ের সাথে অন্য বিষয়ের সাদৃশ্য খোঁজার অভ্যাস গড়ে তোলেন। এর ফলে তাঁরা যখন রাজনীতির দিকে নজর দেন, তখন তাঁরা রাজনীতিকেও তত্ত্ব ও যুক্তি-প্রমাণের কাঠামোতে ঢেলে সাজাতে চান। ফলে অধিকাংশ সময়ে তাঁরা বিভ্রান্তিতে পড়েন, এবং মানুষের কাছে অবিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন।"

অর্থাৎ, যারা সবসময় নীতি-নৈতিকতা নিয়ে থাকেন, এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে থাকেন, তাঁরা মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে খুব বেশী মূল্যায়ন করতে পারেন না। ফলে তাঁরা সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করে রাজনীতিও করতে পারেন না।

ইবনে খালদুন রাজনীতি করার জন্যে তিনটি শর্ত দিয়েছেন।

১) সাধারণ মানুষের সাথে মিশে চলার মতো মানুষ। (العامي)

২) সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। অর্থাৎ যারা মানুষের অধিকারের জন্যে সার্বক্ষণিক দৌড়াতে পারেন। (السليم الطبع)

৩) মধ্যম মানের জ্ঞানী। অর্থাৎ, যারা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু বেশি জ্ঞান রাখেন, কিন্তু আবার আলেম-ওলামা বা বুদ্ধিজীবীদের মতো তত্ত্ব দিয়ে সারাক্ষণ মানুষের ভুল ধরতে বসে থাকেন না, বা মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দিয়ে বেড়ান না। (المتوسط الكيس)

উপরোক্ত তিনটি গুণ যাদের থাকে, ইবনে খালদুনের মতে, তারাই রাজনীতিতে সফল হন।

উদাহরণ স্বরূপ তুরস্ক থেকে একটি উদাহরণ আমরা দিতে পারি। তুরস্কের ইসলামপন্থী দল সাদাত পার্টির প্রধান কারামোল্লাউলুকে বলা হয় তথ্য সম্রাট। উনার অনেক জ্ঞানের জন্যেই উনাকে এমন উপাধি দেয়া হয়েছে। কিন্তু, তিনি তুরস্কের রাজনীতিতে সফল নন। একইভাবে আহমদ দাউতউলু ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। তিনি অনেক বড় বুদ্ধিজীবী, কিন্তু এরদোয়ানের মতো রাজনীতিতে তিনি সফল নন। এরদোয়ান তুরস্কের রাজনীতিতে সফল হবার কারণ, তিনি মধ্যম মানের জ্ঞানী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে পারেন।

আবারো ইবনে খালদুনের কথায় ফিরে আসি। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যখন মানুষকে নৈতিকতা শিখাতে চান, তখন তাঁরা ব্যর্থ হন। আবার যারা নৈতিকতা শিক্ষা দেন, তাঁরা যখন রাজনীতি করতে যান, তখন তারাও ব্যর্থ হন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

মাথায় রুমাল দেয়া কি মাদানী হুজুর হবার লক্ষণ? নাকি ইহুদি হবার লক্ষণ?

এক তথাকথিত সালাফী মাদানী হুজুর নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে ভ্রান্ত মনে করেন। অথচ, নিজেই ইহুদিদের মতো মাথায় রুমাল দিয়ে ওয়াজ করেন। মাথায় রুমাল দেয়ার বিরুদ্ধে যেসব সহীহ হাদিস আছে, তা কি তিনি দেখননি? দলীল – ১ يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ দাজ্জালের বাহিনীতে ৭০ হাজার ইহুদী থাকবে, যাদের মাথায় চাদর বা রুমাল থাকবে। সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৯৪৪ দলীল – ২ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَعِيدٍ الخُزَاعِيُّ، حَدَّثَنَا زِيَادُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ، قَالَ: نَظَرَ أَنَسٌ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَرَأَى طَيَالِسَةً، فَقَالَ: «كَأَنَّهُمُ السَّاعَةَ يَهُودُ خَيْبَرَ» আনাস ইবনু মালিক (রা) জুমার দিনে মসজিদের মধ্যে সমবেত মানুষের দিকে তাকালেন। তিনি অনেকের মাথায় রুমাল দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এরা এখনো ঠিক খাইবারের ইহুদীদের মত। সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ৪২০৮ দলীল – ৩ قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : ” قال لقمان لابنه وهو يعظه : يا بني إياك والتقنع ، فإنها مخوفة بالليل مذلة بالنهار রাসূল (স) ...

আহলে কোর'আনের কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব - ২

মোহাম্মদ Junaid ভাইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর। ১) ইমামদেরকে standard মানতে হবে কেন? - ইমামদেরকে আমরা প্লেটো বা এরিস্টটলের মতো জ্ঞানী, স্কলার ও আলেম মনে করি, standard নয়। ২) ওনাদের status কী? - পৃথিবীর হাজার হাজার স্কলারের মাঝে ইমামরাও অন্তর্ভুক্ত। ৩) ওনাদের কি সুসংবদ্ধ চিন্তা ছিল? - জ্বী, উনাদের কাজ-ই ছিলো চিন্তাকে ফ্রেম দেওয়া। ৪) ওনাদের রচনাসমগ্ৰ কি সুলভ? - দুর্ভাগ্য আমাদের। বাংলা ভাষায় উনাদের বই পুস্তক অনুবাদ হয়নি। কিন্তু, উনাদের প্রচুর বই আছে, যা আমরা জানি না। ৫) প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত? - জী। ৬) বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তো প্রবহমান নদীর মতো। পুরা যুগের কারো পায়রবিতে আটকে থাকতে হবে কেন? - নদী যেমন তার উৎসের সাথে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না, তেমনি আমরাও আমাদের অতীতের সকল জ্ঞানের উৎসের সাথে বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না। বরং আমাদের জ্ঞানের উৎসে যাবার রাস্তা খোলা রাখতে চাই। ৭) জ্ঞানের পরিমাপক কী? - একজন মানুষ তার সময়ের কতগুলো সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছেন, সেটাই তার জ্ঞানের পরিমাপক। ৮) ওনারা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব গ্ৰহণ করবেন? - অবশ্যই না। তবে, পৃথিবীকে জানা...