সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুতাজিলা কারা ও তাদের মূলনীতি কী?

মুতাজিলা সম্পর্কে কিছু না জেনে অনেকেই তাদেরকে কাফির বলে থাকেন। অথচ, ইমাম আবু হানিফা থেকে শুরু করে অনেকেই মুতাজিলাদের দ্বারা কম-বেশি প্রভাবিত ছিলেন।

মুতাজিলা শব্দটি আজালা (عزل) শব্দমূল থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো দূর হয়ে যাওয়া বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। মুতাজিলারা নিজেরা নিজেদের নাম মুতাজিলা দেয়নি, বরং অন্যরা তাঁদেরকে মুতাজিলা নাম দিয়েছেন।

মুতাজিলা শব্দটি প্রথম কখন ব্যবহার হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। আহলে সুন্নাহ স্কুলের মতে, উস্তাদ হাসান আল বসরি তাঁর ছাত্র ওসেল বিন আতা’র জন্যে প্রথম এই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।

কবিরা গুনাহ করলে মানুষ কি জান্নাতে যাবে, নাকি জাহান্নামে যাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসেল তাঁর উস্তাদের থেকে ভিন্ন মত পোষণ করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যান। এরপর উস্তাদ হাসান আল বসরি বলেছেন - (اعتزل عنا واصل) অর্থাৎ ওসেল আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেন, ওসেল বিন আতা নয়, বরং আমর বিন উবাইদ তাঁর উস্তাদ হাসান আল বসরি থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাঁদেরকে মুতাজিলা বলা হয়।

মুতাজিলাদের চিন্তা প্রধানত দুই ধরণের চিন্তা রয়েছে। ১) আল্লাহর সিফাত ও কুর’আন সৃষ্টি না অসৃষ্টি বিষয়ে। ২) আল্লাহর অস্তিত্ব ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে।

ইসলাম যখন বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেছে, তখন ইসলামকে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। সেই প্রশ্নগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তর দিয়ে ইসলামে রক্ষা করার চেষ্টাই ছিলো মুতাজিলাদের কাজ। তাই আল্লাহর অস্তিত্ব ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি বিষয়ে মুতাজিলাদের সাথে অন্যান্য ইসলামী স্কুলের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। মুতাজিলাদের সাথে অন্য ইসলামী স্কুলের প্রধান পার্থক্য আল্লাহর গুণাবলী বিষয়ে।

অবশ্য, মুতাজিলাদের নিজেদের মধ্যেও আবার অসংখ্য ভিন্ন মতের স্কুল রয়েছে। যেমন, বসরা স্কুল এবং বাগদাদ স্কুল। উভয় স্কুল মুতাজিলাদের মৌলিক পাঁচটি উসুলের সাথে একমত পোষণ করলেও, রাজনৈতিক জায়গা থেকে তাদের অনেক পার্থক্য ছিলো। বসরা স্কুল থেকে মুতাজিলা মাজহাব প্রতিষ্ঠা হলেও বাগদাদ স্কুল রাজধানীতে থাকার কারণে অনেক বেশি প্রচার ও প্রসার হয়েছিলো। বাগদাদ স্কুলের মুতাজিলারা আলী (রা) এবং আহলে বাইতের প্রতি আন্তরিক ছিলেন, আর বসরা স্কুলের মুতাজিলারা আব্বাসিদের প্রতি বেশি আন্তরিক ছিলেন।

সে যাই হোক, মুতাজিলাদের ইসলাম বুঝার মেথডলজি ৫টি মৌলিক উসুল বা ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

১) তাওহীদ। (التوحيد)

তাওহীদের ক্ষেত্রে মুতাজিলারা সালাফিদের চেয়েও বেশি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। মুতাজিলাদের মতে, কোনো কিছুই আল্লাহর মতো নয়, এমনকি কোর’আনও নয়। কোর’আনকে যদি চিরস্থায়ী মনে করা হয়, তাহলে তা আল্লাহর সাথে শিরক হয়ে যায়। কারণ, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই চিরস্থায়ী, অন্য কিছু চিরস্থায়ী হতে পারে না।

২) আদালত। (العدل)

মুতাজিলাদের মতে, আল্লাহ তায়ালার দ্বারা কোনো অন্যায় কাজ করা সম্ভব নয়। যেমন, কোর’আনে সূরা লাহাবে আল্লাহ তায়ালা আবু লাহাবকে অভিশাপ দিয়েছেন। মুতাজিলাদের মতে, আল্লাহ তায়ালা কখনো কাউকে কখনো অন্যায় অভিশাপ দিতে পারেন না। আবু লাহাব যেহেতু তখনো জীবিত ছিলেন, তাই আবু লাহাব হিদায়েত পাবার সম্ভাবনাও ছিলো। আল্লাহ তায়ালা জীবিত আবু লাহাবকে কখনোই অভিশাপ দেননি, বরং আবু লাহাব চরিত্রের মানুষকে অভিশাপ দিয়েছেন। অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা ন্যায় বিচারের বাইরে যেতে পারেন না।

৩) যেমন কর্ম তেমন ফল। (الوعد والوعيد)

মুতাজিলাদের মতে, প্রত্যেক মানুষকে অবশ্যই তার কর্মের ফল পেতে হবে। কেউ গুনাহ করে দুনিয়াতে তাওবা না করে মারা গেলে, তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা আখিরাতে কাউকে মাফ করবেন, আর কাউকে মাফ করবেন না, এমন অন্যায় আল্লাহ কখনো করতে পারেন না।

আশয়ারিদের মতে, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করলে আখিরাতে তাঁর পাপী বান্দাকেও ক্ষমা করে দিতে পারেন। এবং সৎ ব্যক্তিরা পাপী ব্যক্তিদের জন্যে সুপারিশও করতে পারবেন। কিন্তু, মুতাজিলাদের মতে, একজন ব্যক্তি দুনিয়াতে যতটুকু ভালো কাজ করেছে, কেবল ততটুকুই পুরষ্কার পাবে। এবং যতটুকু খারাপ কাজ করেছে, ততটুকু খারাপ কাজের শাস্তি অবশ্যই পাবে।

৪) জান্নাত-জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থান। (المنزلة بين المنزلتين)

আশয়ারিদের মতে, কোনো মুসলিম কবিরা গুনাহ করলে কিছুদিন জাহান্নামে থেকে আবার জান্নাতে যেতে পারবে। কিন্তু, মুতাজিলাদের মতে, কেউ কবিরা গুনাহ করে তওবা না করে মারা গেলে, সে আর মুসলিম থাকতে পারে না। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। অন্যদিকে, কেউ ছোট গুনাহ করে এবং তাওবা না করে মারা গেলে, সে মুসলিমও হবে না, আবার কাফিরও হবে না। এমতাবস্থায় ঐ ব্যক্তি জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি স্থানে থাকবে।

৫) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। (الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر)

অশয়ারিদের মতে, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রতিটি মুসলিমের জন্যে ফরজে আইন নয়, বরং ফরজে কিফায়া। যে যার সাধ্যানুযায়ী সৎ কাজের আদেশ দিবেন, এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবেন। কিন্তু, মুতাজিলাদের মতে, সকল মুসলিমের জন্যে নামাজ-রোজার মতোই সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজের নিষেধ করা ফরজে আইন।

উপরোক্ত পাঁচটি উসুল বা সূত্র অনুযায়ী মুতাজিলা স্কুলের যাবতীয় বই-পুস্তক রচিত হয়। যে কাউকে আমরা কাফের বলে দিতে পারি, এটা খুব সহজ। কিন্তু, যে কোনো মানুষ বা স্কুলের চিন্তার বিপরীতে বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলা করাটা কঠিন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

গণতন্ত্র সময়ের একটি চাহিদা

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনের কথা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? ধরুন, ১৬১৭ সাল। উসমানী খেলাফতের অধীনে তখন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ ভূমি। সেই এক-তৃতীয়াংশ ভূমির খেলাফতের দায়িত্ব পালন করছেন সুলতান আহমদ। কেউ যদি তখন বলতো, আমরা সুলতান আহমদের পরিবর্তন চাই এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। তাহলে তখন কিভাবে সে নির্বাচনটি হত? তখন তো আর ইন্টারনেট বা টেলিভিশন ছিল না, এমনকি প্লেনও ছিল না। নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচনী তফসিলটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রত্যেকের কাছে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে করতে কমপক্ষে ৩ বছর সময় লেগে যেতো। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকল মানুষ যেহেতু খলীফা প্রার্থী হবার অধিকার রাখে, সুতরাং নির্বাচন কমিশনারের কাছে তাঁদের মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে করতে সময় লাগতো আরো ২ বছর। নির্বাচন কমিশনার লক্ষ লক্ষ মনোনয়ন পত্র বাচাই করতে করতে লাগতো আরো ১ বছর। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের এবং আপিল নিষ্পত্তি করতে সময় লাগতো কমপক্ষে আরো ৫ বছর। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার সময় দিতে হতো কমপক্ষে আরো ১ বছর। কারণ প্রার্থীদেরকে বহুদূর থেকে এসে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হতো। তারপর, প্রা...