সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কল্যাণ রাষ্ট্রের পরিচয়

একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের উপাদান পাঁচটি। যদি এই পাঁচটি উপাদান কোনো রাষ্ট্রে থাকে, তাহলে সেটি একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত হবে।

১) আদালত।

ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, গোত্র ও জাতি নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিককে তাঁর ন্যায্য অধিকার দেয়ার নাম আদালত। আদালত ধারণা দিতে কোর'আনে বলা হয়েছে -

لَا يَنْهٰيكُمُ اللّٰهُ عَنِ الَّذ۪ينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدّ۪ينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُمْ مِنْ دِيَارِكُمْ اَنْ تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُٓوا اِلَيْهِمْۜ اِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ الْمُقْسِط۪ينَ

“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নাই এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করে নাই, তাঁদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন”। [মুমতাহিনা – ৮]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন -

يَٓا اَيُّهَا الَّذ۪ينَ اٰمَنُوا كُونُوا قَوَّام۪ينَ لِلّٰهِ شُهَدَٓاءَ بِالْقِسْطِۘ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰٓى اَلَّا تَعْدِلُواۜ اِعْدِلُوا۠ هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰىۘ وَاتَّقُوا اللّٰهَۜ اِنَّ اللّٰهَ خَب۪يرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

“হে মুমিনগণ, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনোও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে। কারণ, এটি তাকওয়ার নিকটতর। আর আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ তার খবর রাখেন”। [মায়েদা – ৮]

উপরোক্ত দুটি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও ভিন্ন জাতির প্রতি বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি সুবিচার করতে হবে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার ন্যায্য অধিকার তাদেরকে দিতে হবে।

২) আমানত।

একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিটি শাখায় আমানত বজায় রাখা হয়। দেশকে এবং দেশের যাবতীয় সম্পদকে শাসকগণ আমানত মনে করে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। শাসক বা সরকারের কেউ দেশের কোনো সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করে ভক্ষণ করতে পারবে না।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন -

وَالَّذ۪ينَ هُمْ لِاَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَۙ

“যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে”। [মুমিনুন - ৮]

৩) আহলিয়াত বা লিয়াকাত।

পৃথিবীর মালিক হলো আল্লাহ তায়ালা। তিনি মানুষের কাছে তাঁর পৃথিবীকে আমানত দিয়েছেন। মানুষ তাঁদের সে আমানত একজন শাসকের কাছে আমানত রাখে। মানুষ যখন শাসকের কাছে তাদের দেশকে চায়, তখন শাসক তা মানুষদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ, সম্পদ তাঁর মালিকের কাছে যথাযথভাবে ফিরিয়ে দেয়ার নাম আহলিয়াত। আর, লিয়াকাত হলো, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য পদে নিযুক্ত করা।

আল্লাহ বলেন -

اِنَّ اللّٰهَ يَأْمُرُكُمْ اَنْ تُؤَدُّوا الْاَمَانَاتِ اِلٰٓى اَهْلِهَاۙ وَاِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ اَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِۜ اِنَّ اللّٰهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِه۪ۜ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ سَم۪يعًا بَص۪يرًا

“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানত তাঁর হকদারকে ফিরিয়ে দিবে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে উপদেশ দেন, তা কত উৎকৃষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [নিসা - ৫৮]

৪) মাশওয়ারাত বা শূরা।

একক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে নয়, বরং সামষ্টিক চিন্তার সমন্বয়ে দেশ পরিচালনার নাম মাশওয়ারাত। অর্থাৎ, একক কোনো ধর্ম বা একক কোনো জাতি, অথবা একক কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্তে দেশ পরিচালিত হবে না। বরং দেশের সকল মানুষের থেকে মতামত নিয়ে যে দেশ পরিচালিত হবে, সেটা হবে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র।

আল্লাহ তায়ালা বলেন -

وَالَّذ۪ينَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمْ وَاَقَامُوا الصَّلٰوةَۖ وَاَمْرُهُمْ شُورٰى بَيْنَهُمْۖ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَۚ

"যারা তদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দেয়, সালাত কায়েম করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে এবং তাহাদিগকে আমি যে রিজিক দিয়েছি, তা ব্যয় করে।” [৪২/ শূরা - ৩৮]

৫) মাসলাহাত।

সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ কেবলমাত্র জনগণের কল্যাণের জন্যেই হতে হবে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে এমন কিছু মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী বা সরকারের সমালোচনাকারী থাকবে, যারা নিয়মিত সরকারের ভুলগুলো সংশোধন করে দিবে। সরকারও তার সমালোচনাকারীদের সমালোচনাকে নিয়মিত পর্যালোচনা করে ভুল-ভ্রান্তি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করবে। এর নামই মাসলাহা। মাসলাহার মূল উদ্দেশ্য সরকারকে এবং সাধারণ মানুষকে যাবতীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা।

আল্লাহ তায়ালা বলেন -

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ اُمَّةٌ يَدْعُونَ اِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِۜ وَاُو۬لٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“তোমাদের মধ্যে এমন একদল হউক যাহারা কল্যাণের দিকে মানুষকে আহবান করবে। এবং সৎকর্মের নির্দেশ দিবে ও অসৎকর্মের নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম। [৩/আলে ইমরান – ১০৪]
_______

উপরোক্ত পাঁচটি উপাদান যে রাষ্ট্রে থাকে, সেটি একটি কল্যাণ রাষ্ট্র।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

মাথায় রুমাল দেয়া কি মাদানী হুজুর হবার লক্ষণ? নাকি ইহুদি হবার লক্ষণ?

এক তথাকথিত সালাফী মাদানী হুজুর নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে ভ্রান্ত মনে করেন। অথচ, নিজেই ইহুদিদের মতো মাথায় রুমাল দিয়ে ওয়াজ করেন। মাথায় রুমাল দেয়ার বিরুদ্ধে যেসব সহীহ হাদিস আছে, তা কি তিনি দেখননি? দলীল – ১ يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ দাজ্জালের বাহিনীতে ৭০ হাজার ইহুদী থাকবে, যাদের মাথায় চাদর বা রুমাল থাকবে। সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৯৪৪ দলীল – ২ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَعِيدٍ الخُزَاعِيُّ، حَدَّثَنَا زِيَادُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ، قَالَ: نَظَرَ أَنَسٌ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَرَأَى طَيَالِسَةً، فَقَالَ: «كَأَنَّهُمُ السَّاعَةَ يَهُودُ خَيْبَرَ» আনাস ইবনু মালিক (রা) জুমার দিনে মসজিদের মধ্যে সমবেত মানুষের দিকে তাকালেন। তিনি অনেকের মাথায় রুমাল দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এরা এখনো ঠিক খাইবারের ইহুদীদের মত। সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ৪২০৮ দলীল – ৩ قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : ” قال لقمان لابنه وهو يعظه : يا بني إياك والتقنع ، فإنها مخوفة بالليل مذلة بالنهار রাসূল (স) ...

আহলে কোর'আনের কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব - ২

মোহাম্মদ Junaid ভাইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর। ১) ইমামদেরকে standard মানতে হবে কেন? - ইমামদেরকে আমরা প্লেটো বা এরিস্টটলের মতো জ্ঞানী, স্কলার ও আলেম মনে করি, standard নয়। ২) ওনাদের status কী? - পৃথিবীর হাজার হাজার স্কলারের মাঝে ইমামরাও অন্তর্ভুক্ত। ৩) ওনাদের কি সুসংবদ্ধ চিন্তা ছিল? - জ্বী, উনাদের কাজ-ই ছিলো চিন্তাকে ফ্রেম দেওয়া। ৪) ওনাদের রচনাসমগ্ৰ কি সুলভ? - দুর্ভাগ্য আমাদের। বাংলা ভাষায় উনাদের বই পুস্তক অনুবাদ হয়নি। কিন্তু, উনাদের প্রচুর বই আছে, যা আমরা জানি না। ৫) প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত? - জী। ৬) বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তো প্রবহমান নদীর মতো। পুরা যুগের কারো পায়রবিতে আটকে থাকতে হবে কেন? - নদী যেমন তার উৎসের সাথে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না, তেমনি আমরাও আমাদের অতীতের সকল জ্ঞানের উৎসের সাথে বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না। বরং আমাদের জ্ঞানের উৎসে যাবার রাস্তা খোলা রাখতে চাই। ৭) জ্ঞানের পরিমাপক কী? - একজন মানুষ তার সময়ের কতগুলো সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছেন, সেটাই তার জ্ঞানের পরিমাপক। ৮) ওনারা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব গ্ৰহণ করবেন? - অবশ্যই না। তবে, পৃথিবীকে জানা...