সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শাসকের সাথে সালাফীদের সম্পর্ক

বাংলাদেশের সালাফী আলেমদের কেউ কেউ বলেন, “কোনো দেশের শাসক ভালো হোক বা মন্দ হোক, তার বিরোধীতা করা যাবে না।”

সালাফী আলেমরা এ কথা বলেন ইমাম আত-তাহাওয়ীর সূত্র ধরে। ইমাম তাহাওয়ী তাঁর আকীদার গ্রন্থে বলেছেন –

ولا نرى السيف على أحد من أمة محمد صلى الله عليه وعلى آله وسلم إلا من وجب عليه السيف. ولا نرى الخروج على أئمتنا وولاة أمورنا. وإن جاروا. ولا ندعو عليهم . ولا ننزع يداً من طاعتهم. ونرى طاعتهم من طاعة الله عز وجل فريضة، ما لم يأمروا بمعصية. وندعو لهم بالصلاح والمعافاة

ونتبع السنة والجماعة، ونجتنب الشذوذ والخلاف والفرقة. ونحب أهل العدل والأمانة، ونبغض أهل الجور والخيانة.
[متن العقيدة الطحاوية ص: 161]

“মুহাম্মদ (স)-এর উম্মতের মধ্যে কারো বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার পক্ষে আমরা মত দেই না। তবে কারো বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করা যদি ওয়াজিব হয়, সেটা ভিন্ন কথা। আমীর, শাসক ও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পক্ষেও আমরা মত দেই না, যদিও তারা অত্যাচারী হয়। আমরা তাদেরকে অভিশাপ দেই না, এবং তাদের আনুগত্য হতে হাত গুটিয়ে নেই না। তাদের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যের সাপেক্ষে ফরজ, যতক্ষণ না তাঁরা আল্লাহর অবাধ্যচরণের আদেশ দেয়। আমরা তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্যে দোয়া করবো।

আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অনুসরণ করবো। আমরা জামাআত হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং জামাআতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হতে বিরত থাকবো। আমরা ন্যায়পরায়ন ও আমানতদার ব্যক্তিদেরকে ভালোবাসবো, এবং অন্যায়কারী ও আমানতের খিয়ানতকারীদের সাথে শত্রুতা পোষণ করবো।”

ইমাম তাহাওয়ীর উপরোক্ত সূত্র ধরে বাংলাদেশের সালাফি আলেমরা বলেন, সরকারের কোনো বিরোধীতা করা যাবে না। কিন্তু এ ফতোয়া দেয়ার আগে বাংলাদেশের সালাফী আলেমগণ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখেন না।

১) সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা, সকারের দুর্নীতি মানুষকে জানানো, সরকারের বিপক্ষে জনমত গঠন করা এবং বিরোধী দল গঠন করা এক জিনিস, আর সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা, সরকারকে ঝামেলায় ফেলার জন্যে দেশের সাধারণ মানুষের উপর বোমাবাজি অন্য জিনিস। ইমাম আত-তাহওয়ী সরকারের বিরুদ্ধে কেবল অস্ত্র ধারণ করার বিরোধীতা করেছেন, কিন্তু, আমাদের সালাফী আলেমগণ সরকারের যে কোনো সমালোচনাকেই হারাম মনে করেন।

২) ইমাম আত-তাহাওয়ীর সময়ে অস্ত্র ছাড়া কোনো শাসককে পরিবর্তন করা যেতো না। কিন্তু বর্তমানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো ধরণের রক্তারক্তি ছাড়াও শাসকের পরিবর্তন করা যায়। সুতরাং তখনকার সময়ে সরকারের বিরোধিতা করা, আর এখনকার সময়ে সরকারের বিরোধীতা করা এক নয়। এখন অস্ত্র ছাড়াও সরকারের বিরোধীতা করা যায়।

৩) ইমাম তাহাওয়ীর জন্ম ২২৯ বা ২৩৯ হিজরিতে। তাঁর অনেক আগে, ৮০ হিজরিতে জন্ম নেয়া ইমাম আবু হানিফা সরকারের আনুগত্য করাকে আকীদার অংশ হিসাবে উল্লেখ করেননি। কিন্তু, ইমাম আত-তাহাওয়ী সকরকারের বিরুদ্ধাচারণ না করে সরকারের আনুগত্য করাকে ইসলামী আকীদার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ, হজরত উসমান (রা) থেকে শুরু করে অসংখ শাসক ও খলিফা তাদের বিদ্রোহীদের হঠাৎ আক্রমণে নিহিত হয়েছিলেন। তাই এই ধরণের জঙ্গি আক্রমণ দমন করার জন্যে সরকারের আনুগত্যকে ইসলামী আকীদার অন্তভুক্ত করেছেন ইমাম আত-তাহওয়ী। কিন্তু তাঁর আগে ও পরের অনেক মুসলিম স্কলার সরকারের আনুগত্যকে ইসলামী আকীদার অন্তর্ভুক্ত করেননি।

৪) ইমাম আত-তাহাওয়ী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করার কথা বলার পরে সাথে সাথেই আবার বলেন যে, যারা অত্যাচার করে এবং আমানত খেয়ানত করে তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করতে হবে। কিন্তু এ কথাটা আমাদের দেশের সালাফী আলেমগন কখনো উল্লেখ করেন না। তাঁরা কেবল বলেন, শাসকের বিরোধীতা করা যাবে না। কিন্তু, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে যে সরকার বিনা অপরাধে গুম, খুন ও ধর্ষণ করে, এবং যে সরকার মানুষের ট্যাক্স-কর জাতীয় আমানতের টাকা খেয়াতন করে, তাদের সাথে শত্রুতার যে কথা ইমাম আত-তাহাওয়ী বলেছেন, তা বলতে ভুলে যান আমাদের সালাফী শায়েখগণ।

৫) ইমাম আত-তাহাওয়ীর এই তত্ত্বকে আরো বিস্তারিতভাবে বলেছেন ইমাম গাজালী। ইমাম গাজালীর মতে, কোনো শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আগে দেখতে হবে, তাতে জনগণের অতিরিক্ত ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে কিনা। যদি কোনো শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে জনগণের অসহনীয় কষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। কিন্তু, যদি অধিকাংশ জনগণ শাসকের বিরুদ্ধে হয়, তখন শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে। [সূত্র, ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন, ১ম খণ্ড, ২৩৬]

৬) মূলত মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঐক্য ধরে রাখার জন্যেই ইমাম আত-তাহাওয়ী তাঁর এই নীতি প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু সালাফী আলেম ইমাম আত-তাহাওয়ীকে ব্যবহার করে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তি আরো বাড়াচ্ছেন।

৭) গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের বিরোধীতা করার পদ্ধতি ইমাম তাহাওয়ীর সময়ে ছিলো না। যদি থাকতো তাহলে তিনিও অত্যাচারী শাসকের বিরোধীতাকে সমর্থন করতেন। কারণ, মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করা, আর গণতান্ত্রিক উপায়ে অত্যাচারী শাসকের বিরোধীতা করা এক নয়। এখন রক্তারক্তি ছাড়াও অত্যাচারী শাসককে ক্ষতাচ্যুত করা যায়, কিন্তু আগে শাসককে খুন করা ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত করা কষ্টকর হতো। সুতরাং, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং জনগণের সমর্থণে অত্যাচারী শাসকের বিরোধীতা করা এখন দোষের কিছু নয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।