সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আধুনিক খারিজিদের চরিত্র

অন্যকে কাফির ঘোষণা দিয়ে নিজেদের ধার্মিকতা প্রদর্শনে খারেজিরা ছিলো সবার সেরা। আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে যেসব খারেজি বিদ্রোহ করেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলো কোর’আনে হাফিজ। খারিজিদের মুখে ছিলো লম্বা দাঁড়ি, এবং কপালে ছিলো নামাজের দাগ। খারিজিদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব রাসিবী এতো বেশি ইবাদাত ও সিজদা করতো যে, তার সিজদার স্থানসমূহের চামড়া শুকিয়ে গিয়েছিলো।(১)

খারিজিদের মধ্যে যারা আলী (রা)-কে হত্যা করা পরিকল্পনা করেছিলো, তারা আলী (রা)-কে হত্যা করার জন্যে রমাজান মাস আসার অপেক্ষা করেছিলো। তাদের ধারণা ছিলো, রমাজান মাসে একটা কাফির হত্যা করতে পারলে বেশি সাওয়াব পাওয়া যাবে।(২)

কিতাম বিনতে শাজানাহ নামক যে সুন্দরী নারী বলেছেন, “আমাকে বিয়ে করতে হলে আলীকে হত্যা করতে হবে”, সে নারী দিনরাত সারাক্ষণ মসজিদে ইবাদাত-বন্দেগীতে নিমগ্ন থাকতেন।(৩)

আলী (রা)-এর হত্যাকারী ইবনে মুলজিম তার সহযোগী শাবীবকে বলেন – “তুমি কি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভ করতে চাও? যদি চাও, তাহলে আলীকে হত্যা করতে হবে।(৪)

ইবনে মুলজিম যখন আলী (রা)-এর মাথায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করছিলো, তখনো সে জোরে জোরে কোর’আনের আয়াত তেলোয়াত করেছিলো। আলী (রা)-কে হত্যা করার সময়ে সে বলছিলো – “আল্লাহ ছাড়া কারোও হুকুম করার অধিকার নেই। হে আলী! তোমারও নেই এবং তোমার অনুসারীদেরও নেই”। হত্যাকারী তখন সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াত পড়ছিলো – “মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভার্থে আত্ম-বিক্রয় করে থাকে। আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র”।(৫)

খারিজিদের মূল কাজ হলো, তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে ভালো মুসলিম দাবী করে, এবং অন্য সবাইকে কাফির বা ভ্রান্ত ঘোষণা করে। এমন চরিত্রের মানুষ এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। খারিজিদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ান যুদ্ধ শেষ করে ফেরার পথে সৈন্যরা আলী (রা)-এর কাছে এসে বলতে লাগলেন, “হে আমীরুল মুমিনীন! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি খারিজীদের মূলোৎপাটন করে দিয়েছেন”। আলী (রা) তখন তাদেরকে বললেন, “কখনো না, আল্লাহর কসম! তারা অবশ্যই পুরুষ লোকের পৃষ্ঠদেশে এবং মেয়ে লোকের গর্ভে বিদ্যমান আছে। যখন তারা তাদের বাবা-মা থেকে বেরিয়ে আসবে, তখন তাদের সাথে যার-ই সাক্ষাৎ হবে, তার উপর প্রাধান্য বিস্তারের জন্যে তারা ফিতনা সৃষ্টি করতে থাকবে।”(৬) আলী (রা)-এর এই ভবিষ্যৎ বাণী আমরা এখনো দেখতে পাই। অনেক মুসলিম নিজেকে বড় মুসলিম হিসাবে প্রমাণ করার জন্যে অন্যদেরকে কাফির ফতোয়া দিতে থাকেন।

যাই হোক, আধুনিক খারিজিরা সবাইকে কাফির বানিয়ে দিলেও, তাদেরকে কিন্তু কাফির-মুনাফিক বলা যাবে না। কারণ, খারিজিরা আলী (রা)-কে কাফির ঘোষণা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরেও আলী (রা) খারিজিদেরকে মুশরিক বা মুনাফিক বলতে নারাজ ছিলেন। নাহরাওয়ান যুদ্ধের শেষে সৈন্যরা আলী (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “খারিজিরা কি মুশরিক?” আলী (রা) বললেন, “শিরক থেকে বাঁচার জন্যেই তো তারা আলাদা হয়ে গেছে”। সৈন্যরা বললেন, “তাহলে কি তারা মুনাফেক?” আলী (রা) বললেন, “মুনাফিকরা তো খুবই কম আল্লাহকে স্মরণ করে”। তখন সৈন্যরা বললেন, “হে আমীরুল মুমিনীন! তাহলে খারিজিরা আসলে কি?” আলী (রা) বললেন – “তারা আমাদের ভাই। আমাদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছে। সেই বিদ্রোহের কারণেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।”(৭)

বর্তমানে যারা কথায় কথায় অন্যকে ভ্রান্ত বা কাফির বলেন, এবং নিজেদেরকে অতি-ধার্মিক হিসাবে উপস্থাপন করেন, আমি তাদেরকে অনেক ভয় করি। কারণ, রাসূল (স)-বলেছেন – “আমার উম্মতের এমন একদল লোক বের হবে, তারা এমনভাবে কোর’আন তেলোয়াত করবে যে, তাদের তেলোয়াতের কাছে তোমাদের তেলোয়াতকে তুচ্ছ মনে হবে। তারা এমনভাবে সালাত পড়বে যে, তাদের সালাতের কাছে তোমাদের সালাতকে তুচ্ছ মনে হবে। তারা এমনভাবে সাওম পালন করবে যে, তাদের সাওমের কাছে তোমদের সাওমকে তুচ্ছ মনে হবে। তারা মনে করবে, কোর’আন তাদের কল্যাণ ডেকে আনবে, আসলে কিন্তু কোর’আন তাদের অকল্যাণ ডেকে আনবে। তারা এমনভাবে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে, যেমনভাবে তীর তার শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়।”(৮)

সূত্র -

(১)
: وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ وَهْبٍ الرَّاسِبِيُّ قَدْ قَحِلَتْ مَوَاضِعُ السُّجُودِ منه من شدة اجتهاده وكثرة السجود، وكان يقال له: ذو البينات.

[البداية والنهاية ط إحياء التراث 7/ 321]
(২)
فَتَعَاهَدُوا وَتَوَاثَقُوا أَنْ لَا يَنْكِصَ رَجُلٌ مِنْهُمْ عَنْ صَاحِبِهِ حَتَّى يَقْتُلَهُ أَوْ يَمُوتَ دُونَهُ فَأَخَذُوا أَسْيَافَهُمْ فَسَمُّوهَا وَاتَّعَدُوا لِسَبْعَ عَشْرَةَ مِنْ رَمَضَانَ
[البداية والنهاية ط إحياء التراث 7/ 361]
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইফা, ৭ম খণ্ড, ৫৭৮
(৩)
إذا أَقْبَلَتِ امْرَأَةٌ مِنْهُمْ يُقَالُ لَهَا قَطَامِ بِنْتُ الشِّجْنَةِ (3) ، قَدْ قَتَلَ عَلِيٌّ يَوْمَ النَّهْرَوَانِ أَبَاهَا وَأَخَاهَا، وَكَانَتْ فَائِقَةَ الْجَمَالِ مَشْهُورَةً بِهِ، وَكَانَتْ قَدِ انْقَطَعَتْ فِي الْمَسْجِدِ الْجَامِعِ تَتَعَبَّدُ فِيهِ، فَلَمَّا رَآهَا ابْنُ مُلْجَمٍ سَلَبَتْ عَقْلَهُ وَنَسِيَ حَاجَتَهُ الَّتِي جَاءَ لَهَا، وَخَطَبَهَا إِلَى نَفْسِهَا فَاشْتَرَطَتْ عَلَيْهِ ثَلَاثَةَ آلَافِ دِرْهَمٍ وَخَادِمًا وَقَيْنَةً.
وَأَنْ يَقْتُلَ لَهَا عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ.

[البداية والنهاية ط إحياء التراث 7/ 361]
(৪)
قَالَ لَهُ ابْنُ مُلْجَمٍ: هَلْ لَكَ فِي شَرَفِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ؟ فَقَالَ: وَمَا ذَاكَ: قَالَ؟ قَتْلُ عَلِيٍّ،
[البداية والنهاية ط إحياء التراث 7/ 361]
(৫)

لَا حُكْمَ إِلَّا لِلَّهِ لَيْسَ لَكَ يَا عَلِيُّ وَلَا لِأَصْحَابِكَ، وَجَعَلَ يَتْلُو قَوْلُهُ تعالى * (وَمَنْ النَّاسِ مَنْ يشرط نفسه ابتغاء مرضات الله والله رؤوف بِالْعِبَادِ) * [البقرة: 207]
(৬)
لما أقبل أَهْلَ النَّهْرَوَانِ جَعَلَ النَّاس يَقُولُونَ: الْحَمْدُ لِلَّهِ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِي قَطَعَ دَابِرَهُمْ.
فَقَالَ عَلِيٌّ: كَلَّا وَاللَّهِ إِنَّهُمْ لَفِي أَصْلَابِ الرِّجَالِ وَأَرْحَامِ النِّسَاءِ، فَإِذَا خَرَجُوا مِنْ بَيْنِ الشَّرَايِينِ فقل ما يلقون أحداً إلا ألبوا أَنْ يَظْهَرُوا عَلَيْهِ،
[البداية والنهاية ط إحياء التراث 7/ 321]
(৭)
سُئِلَ عَلِيٌّ عَنْ أَهْلِ النَّهْرَوَانِ أَمُشْرِكُونَ هُمْ؟ فَقَالَ: مِنَ الشِّرْكِ فَرُّوا، قِيلَ أَفَمُنَافِقُونَ؟ قَالَ: إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا: فَقِيلَ فَمَا هُمْ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ؟ قَالَ: إِخْوَانُنَا بَغَوْا عَلَيْنَا فَقَاتَلْنَاهُمْ بِبَغْيِهِمْ عَلَيْنَا.

[البداية والنهاية ط إحياء التراث 7/ 321]

(৮)

فقال علي: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وسلَّم يَقُولُ: " يَخْرُجُ قَوْمٌ مِنْ أُمَّتِي يَقْرَأُونَ الْقُرْآنَ لَيْسَ قِرَاءَتُكُمْ إِلَى قراءتهم بشئ، ولا صلاتكم إلى صلاتهم بشئ، ولا صيامكم إلى صيامهم بشئ، يقرأون القرآن يحسبون أنه لهم وهو عليهم [لَا تُجَاوِزُ صَلَاتُهُمْ تَرَاقِيَهُمْ.
يَمْرُقُونَ مِنَ الْإِسْلَامِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ]
[البداية والنهاية ط إحياء التراث 7/ 321]

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

মাথায় রুমাল দেয়া কি মাদানী হুজুর হবার লক্ষণ? নাকি ইহুদি হবার লক্ষণ?

এক তথাকথিত সালাফী মাদানী হুজুর নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে ভ্রান্ত মনে করেন। অথচ, নিজেই ইহুদিদের মতো মাথায় রুমাল দিয়ে ওয়াজ করেন। মাথায় রুমাল দেয়ার বিরুদ্ধে যেসব সহীহ হাদিস আছে, তা কি তিনি দেখননি? দলীল – ১ يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ দাজ্জালের বাহিনীতে ৭০ হাজার ইহুদী থাকবে, যাদের মাথায় চাদর বা রুমাল থাকবে। সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৯৪৪ দলীল – ২ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَعِيدٍ الخُزَاعِيُّ، حَدَّثَنَا زِيَادُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ، قَالَ: نَظَرَ أَنَسٌ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَرَأَى طَيَالِسَةً، فَقَالَ: «كَأَنَّهُمُ السَّاعَةَ يَهُودُ خَيْبَرَ» আনাস ইবনু মালিক (রা) জুমার দিনে মসজিদের মধ্যে সমবেত মানুষের দিকে তাকালেন। তিনি অনেকের মাথায় রুমাল দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এরা এখনো ঠিক খাইবারের ইহুদীদের মত। সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ৪২০৮ দলীল – ৩ قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : ” قال لقمان لابنه وهو يعظه : يا بني إياك والتقنع ، فإنها مخوفة بالليل مذلة بالنهار রাসূল (স) ...

আহলে কোর'আনের কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব - ২

মোহাম্মদ Junaid ভাইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর। ১) ইমামদেরকে standard মানতে হবে কেন? - ইমামদেরকে আমরা প্লেটো বা এরিস্টটলের মতো জ্ঞানী, স্কলার ও আলেম মনে করি, standard নয়। ২) ওনাদের status কী? - পৃথিবীর হাজার হাজার স্কলারের মাঝে ইমামরাও অন্তর্ভুক্ত। ৩) ওনাদের কি সুসংবদ্ধ চিন্তা ছিল? - জ্বী, উনাদের কাজ-ই ছিলো চিন্তাকে ফ্রেম দেওয়া। ৪) ওনাদের রচনাসমগ্ৰ কি সুলভ? - দুর্ভাগ্য আমাদের। বাংলা ভাষায় উনাদের বই পুস্তক অনুবাদ হয়নি। কিন্তু, উনাদের প্রচুর বই আছে, যা আমরা জানি না। ৫) প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত? - জী। ৬) বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তো প্রবহমান নদীর মতো। পুরা যুগের কারো পায়রবিতে আটকে থাকতে হবে কেন? - নদী যেমন তার উৎসের সাথে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না, তেমনি আমরাও আমাদের অতীতের সকল জ্ঞানের উৎসের সাথে বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না। বরং আমাদের জ্ঞানের উৎসে যাবার রাস্তা খোলা রাখতে চাই। ৭) জ্ঞানের পরিমাপক কী? - একজন মানুষ তার সময়ের কতগুলো সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছেন, সেটাই তার জ্ঞানের পরিমাপক। ৮) ওনারা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব গ্ৰহণ করবেন? - অবশ্যই না। তবে, পৃথিবীকে জানা...