সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আল্লাহর ভাষা কি আরবি?

অনেকে বলেন, আল্লাহ তায়ালার ভাষা হলো আরবি। এ কথা প্রমাণ করার জন্যে তাঁরা যুক্তি দিয়ে বলেন যে, কোর’আন যেহেতু আল্লাহর বাণী, এবং এটি যেহেতু আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে, সুতরাং আল্লাহ তায়ালার ভাষাও আরবি।

একই যুক্তির ভিত্তিতে ইহুদীরা বলেন, আল্লাহ তায়ালার ভাষা হলো হিব্রু ভাষা। যেহেতু তাওরাত আল্লাহর বাণী, এবং তা হিব্রু ভাষায় নাযিল হয়েছে, সুতরাং আল্লাহ তায়ালার ভাষা হলো হিব্রু।

এ কারণে নাস্তিকরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে – ‘আচ্ছা, তোমাদের আল্লাহ কি আগে হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন, আর এখন আরবি ভাষায় কথা বলেন?’

এর উত্তর খুবই সহজ।

আরবি ও হিব্রু ভাষা সহ পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা-ই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নিজের ভাষা তাঁর সৃষ্ট ভাষার মতো নয়। কোর’আনে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

“কোনো কিছুই আল্লাহর সাদৃশ্য নয়, তিনি শুনেন এবং দেখেন।” [সূরা ৪২/ শূরা - ১১]

অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার ভাষা আমাদের পৃথিবীর মানুষের ভাষার মতো নয়। আমরা আরবি, বাংলা, উর্দু, ফার্সি, টার্কি, ইংরেজি বা হিব্রু, যে ভাষায় কথা বলি না কেন, সে ভাষা আল্লাহ তায়ালার নিজের ভাষা নয়।

কোর’আন আল্লাহর বাণী হলেও আরবি ভাষা যে আল্লাহর ভাষা হতে পারে না, তা বুঝার জন্যে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে, কোর’আন কি?

আমরা যে কোর’আনকে হাতে ধরতে পারি, অথবা, যে কোর’আনকে আমরা কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারি, সেটি হলো কোর’আনের একটি প্রতিকৃতি, কিন্তু সেটি আসল কোর’আন নয়।

কথাটা আরো অনেক সহজ করে ইমাম আবু হানিফা তাঁর ‘ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থে বলেছেন। তিনি বলেন –

واالقرآن كَلَام الله تَعَالَى فِي الْمَصَاحِف مَكْتُوب وَفِي الْقُلُوب مَحْفُوظ وعَلى الألسن مقروء وعَلى النَّبِي عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَام منزل ولفظنا بِالْقُرْآنِ مَخْلُوق وكتابتنا لَهُ مخلوقة وقراءتنا لَهُ مخلوقة وَالْقُرْآن غير مَخْلُوق

“কোর’আন আল্লাহ তায়ালার বাণী, মুসহাফগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ, হৃদয়গুলোর মাঝে সংরক্ষিত, জিহ্বাসমূহের দ্বারা পঠিত, এবং রাসূলুল্লাহ (স)-এর উপর অবতীর্ণ। কুর’আনের জন্যে উচ্চারিত শব্দগুলো সৃষ্ট, কুর’আনের জন্যে আমাদের লিখিত বইটি সৃষ্ট, আমাদের তেলোয়াত সৃষ্ট, কিন্তু কুর’আন সৃষ্ট নয়।”

অর্থাৎ, কোর’আনের শব্দগুলো আমরা যখন আমাদের কণ্ঠে উচ্চারণ করি, কিংবা, কোর’আনে অক্ষরগুলো যখন আমরা কাগজে লিখি, তখন সেটি মানুষের সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু, আল্লাহ বাণী হিসাবে যে কোর’আনের কথা বলা হয়, তা কেউ সৃষ্টি করেনি।

যে কোনো ভাষার যেমন শুরু বা শেষ আছে, তেমনি আরবি বা হিব্রু ভাষারও শুরু বা শেষ আছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যেমন অনন্ত ও অসীম, তেমনি তাঁর ভাষাও অনন্ত ও অসীম। সুতরাং, পৃথিবীর কোনো ভাষাই কখনো আল্লাহ তায়ালার ভাষা হতে পারে না।

ইমাম আবু হানিফা বিষয়টিকে আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলেন –

ويتكلم لا ككلامنا ، ويسمع لا كسمعنا، ونحن نتكلم بالآلات والحروف، والله تعالى يتكلم بلا آلة ولا حروف ، والحروف مخلوقة وكلام الله تعالى غير مخلوق

“আল্লাহ তায়ালা কথা বলেন, তবে তাঁর কথা আমাদের কথা বলার মতো নয়। তিনি শুনেন, তবে তাঁর শোনা আমাদের মতো নয়। আমরা বাগযন্ত্রের ও অক্ষরের সাহায্য কথা বলি, কিন্তু আল্লাহ বাগযন্ত্র ও অক্ষর ছাড়াই কথা বলেন। অক্ষরগুলো সৃষ্ট, কিন্তু আল্লাহর কালাম বা কথা সৃষ্ট নয়।”

অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার ভাষা আছে, কিন্তু সে ভাষা আমাদের মানুষদের কোনো ভাষার মতো নয়।

বাস্তব জগত থেকে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যাবে আশা করি।

ধরুন, আপনার প্রিয়জন অনেক ভাষা জানেন। ফেইসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে তিনি কখনো বাংলা ভাষায়, কখনো ইংরেজি ভাষায়, কখনো আরবি ভাষায়, কিংবা কখনো টার্কি বা ফার্সি ভাষায় আপনাকে ম্যাসেজ পাঠান। তিনি যে ভাষাতেই আপনাকে ম্যাসেজ পাঠান না কেনো, সাথে সাথে তা বাইনারি ভাষায় অর্থাৎ শূন্য ও একে (০, ১) রূপান্তরিত হয়ে যায়। বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি ইত্যাদি ভাষা মোবাইল বুঝে না, সে কেবল একটি ভাষা বুঝে, যার নাম বাইনারি। আপনি আপনার প্রিয়জনকে কোনো ভিডিও, কোনো ছবি, অথবা, কোনো ম্যাসেজ যাই পাঠান না কেন, মোবাইল বা ল্যাপটপ তাকে পরিবর্তন করে তার নিজস্ব ভাষা বাইনারি করে ফেলবে।

যেমন ধরুন, আপনি যদি আপনার প্রিয়জনকে বলেন যে – “I love you”

তাহলে সেটি মোবাইলের ভাষায় হবে – “01101001 00100000 01101100 01101111 01110110 01100101 00100000 01111001 01101111 01110101”

অর্থাৎ, মানুষের ভাষা ও যন্ত্রের ভাষা এক নয়। মানুষ যেভাবে কথা বলে যন্ত্র সেভাবে কথা বলতে পারে না। যন্ত্রের কাছে আরবি, উর্দু, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, টার্কি বা ফার্সি ভাষা বলে কোনো ভাষা নেই, সে শুধু বাইনারি ভাষায় কথা বলতে পারে।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে। তিনি মানুষের মতো কোনো অক্ষর বা ভাষা ছাড়াই কথা বলেন। তাঁর কথা কেবল নবী ও রাসূলগণ বুঝতে পারেন। নবী ও রাসূলগণ আল্লাহর কথাকে তাঁদের নিজেদের ভাষায় রূপান্তরিত করেন। সুতরাং, আল্লাহ তায়ালার ভাষা আরবি, এ কথাটি মারাত্মক ভুল।

নাস্তিকরা যখন বলব, "আল্লাহ তায়ালা আগে হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন, আর এখন আরবি ভাষায় কথা বলেন", তখন তাদেরকে বলতে হবে, আল্লাহ তায়ালা সকল ভাষা ও অক্ষর থেকে পবিত্র। আরবি বা হিব্রু কোনো ভাষায় আল্লাহ কথা বলেন না, আল্লাহ তাঁর নিজের মতো কথা বলেন, যা মানুষের মতো না।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

গণতন্ত্র সময়ের একটি চাহিদা

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনের কথা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? ধরুন, ১৬১৭ সাল। উসমানী খেলাফতের অধীনে তখন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ ভূমি। সেই এক-তৃতীয়াংশ ভূমির খেলাফতের দায়িত্ব পালন করছেন সুলতান আহমদ। কেউ যদি তখন বলতো, আমরা সুলতান আহমদের পরিবর্তন চাই এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। তাহলে তখন কিভাবে সে নির্বাচনটি হত? তখন তো আর ইন্টারনেট বা টেলিভিশন ছিল না, এমনকি প্লেনও ছিল না। নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচনী তফসিলটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রত্যেকের কাছে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে করতে কমপক্ষে ৩ বছর সময় লেগে যেতো। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকল মানুষ যেহেতু খলীফা প্রার্থী হবার অধিকার রাখে, সুতরাং নির্বাচন কমিশনারের কাছে তাঁদের মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে করতে সময় লাগতো আরো ২ বছর। নির্বাচন কমিশনার লক্ষ লক্ষ মনোনয়ন পত্র বাচাই করতে করতে লাগতো আরো ১ বছর। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের এবং আপিল নিষ্পত্তি করতে সময় লাগতো কমপক্ষে আরো ৫ বছর। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার সময় দিতে হতো কমপক্ষে আরো ১ বছর। কারণ প্রার্থীদেরকে বহুদূর থেকে এসে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হতো। তারপর, প্রা...