সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মাতৃগর্ভে কি আছে তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানা সম্ভব?

সূরা লোকমানের শেষ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন – “মাতৃগর্ভে কি আছে তা আল্লাহ জানেন”। কিন্তু আধুনিক যুগে আলট্রাসাউন্ড করেই আমরা জেনে নিতে পারি যে, মায়ের গর্ভের শিশুটি ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে। আল্লাহ যা জানেন, তা তো আমরা নিজেরাই জেনে যেতে পারি। এখানে আল্লাহর বিশেষত্ব আর কি রইলো?

একজন ভাইয়া ইনবক্সে এমন একটি প্রশ্ন করেছেন।

প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগেই সূরা লোকমানের শেষ আয়াতটা দেখে নেই। আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

“কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহ নিকট রয়েছে। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনি জানেন মাতৃগর্ভে কি আছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে। কেউ জানে না কোন স্থানে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।” [সূরা ৩১ / লোকমান - ৩৪]

-------------
ব্যাখ্যা – ১
-------------

এ আয়াতে পাঁচটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। সবগুলো বিষয়ে আল্লাহর জানা আছে, কিন্তু সবগুলো জানা একই ধরণের নয়। যেমন,

১। কেয়ামত। এটি কেবল আল্লাহ তায়ালা-ই জানেন।
২। বৃষ্টি। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেন কিনা, তা এখানে বলা হয়নি।
৩। মাতৃগর্ভে যা আছে। এটা আল্লাহ জানেন। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না, তা বলা হয়নি।
৪। আগামী দিনের উপার্জন। এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না বলা হয়েছে।
৫। মানুষের মৃত্যুর সময়। এটাও আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না বলা হয়েছে।

অর্থাৎ, কেয়ামত, আগামী দিনের উপার্জন এবং মৃত্যুর সময় এ তিনটি বিষয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না বলা হয়েছে। কিন্তু, মাতৃগর্ভে কি আছে, তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না, এটা বলা হয়নি।

-------------
ব্যাখ্যা – ২
-------------

“মাতৃগর্ভে “কি” (ما) আছে, তা আল্লাহ জানেন” এবং “মাতৃগর্ভে “কে” (من) আছে, তা আল্লাহ জানেন” –এ দুটি বাক্য একই রকম নয়।

এখানে, “কি” (ما) এবং “কে” (من) এর পার্থক্যটা বোঝার প্রয়োজন।

আরবি ভাষায়, “কি” (ما) ব্যবহৃত হয় বস্তুর ক্ষেত্রে, এবং “কে” (من) ব্যবহৃত হয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে। উপরোক্ত আয়াতে “কে” শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, বরং “কি” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

অর্থাৎ, মাতৃগর্ভে শিশুটি যখন এক ফোঁটা পানি, অথবা, টুকরো মাংসের মত বস্তু আকারে থাকে, এবং যখন ছেলে না মেয়ে তা নির্ধারিত হয় না, তখনও আল্লাহ জানেন যে, এই একফোঁটা পানি কি ছেলে হবে না মেয়ে হবে এবং এর ভবিষ্যৎ কি হবে।

-------------
ব্যাখ্যা – ৩
-------------

মাতৃগর্ভে যা আছে, তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মানুষ জানতে পারে না, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং আল্লাহ তায়ালা নিজেই মাতৃগর্ভে সন্তানের অবস্থা কখন-কেমন-কিভাবে থাকে, তা জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন –

أَلَمْ يَكُ نُطْفَةً مِّن مَّنِيٍّ يُمْنَىٰ --- ثُمَّ كَانَ عَلَقَةً فَخَلَقَ فَسَوَّىٰ --- فَجَعَلَ مِنْهُ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنثَىٰ

“মানুষ কি স্খলিত শুক্রবিন্দু ছিল না? অতঃপর সে রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ তাকে আকৃতি দান করেন এবং সুঠাম করেন। অতঃপর তিনি তা থেকে পুরুষ ও নারী যুগল সৃষ্টি করেন।” [সূরা ৭৫/ কিয়ামা – ৩৭, ৩৮, ৩৯]

অর্থাৎ, মাতৃগর্ভে যা আছে, তা আল্লাহ তায়ালা নিজেই মানুষদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। যদি আল্লাহ ছাড়া কেউ তা না জানার কথা থাকতো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তা মানুষের নিকট প্রকাশ করে দিতেন না। যেমন আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের কথা কোনো নবী-রাসূলকেও জানান নি। অথচ, মাতৃগর্ভে কি আছে, এবং এটি কখন কোন রূপ ধারণ করে, তা রাসূল (স) নিজেও বলে দিয়েছিলেন।

রাসূল (স) বলেন –

إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ فِي بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ إِلَيْهِ مَلَكًا بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ، فَيُكْتَبُ عَمَلُهُ، وَأَجَلُهُ، وَرِزْقُهُ، وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ، ثُمَّ يُنْفَخُ فِيهِ الرُّوحُ

“তোমাদের প্রত্যেকেই মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত শুক্র হিসেবে জমা থাকো। তারপর চল্লিশ দিন রক্তপিণ্ড হিসাবে, তারপর চল্লিশ দিন গোশতের পিণ্ডাকারে থাকো। তারপর চারটি শব্দ দিয়ে আল্লাহ সেখানে একজন ফেরেশতা পাঠান। ফেরেশতা তাকে চারটি বিষয় লিখে দেয় – কর্ম, মৃত্যু, রিজিক, এবং দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য। এরপর ফেরেশতা সেখানে রূহ ফুঁকে দেন।”
[সহীহ বুখারি, ভাগ্য অধ্যায়, মাকতাবায়ে শামেলা]

এ হাদিসে রাসূল (স) খুবই সূক্ষ্ম ও পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা দিয়েছেন যে, মায়ের গর্ভে সন্তান কখন কি অবস্থা থাকে। যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ সন্তানের অবস্থা না জানতেন, তাহলে রাসূল (স) নিজেও বর্ণনা করতেন না। কারণ, কেয়ামত সম্পর্কে রাসূল (স)-কে যখন জিজ্ঞাস করা হতো, তখন তিনি বলতেন, এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।

সুতরাং, উপরোক্ত কোর’আন ও হাদিস থেকে আমরা দেখলাম যে, মাতৃগর্ভে যা আছে, তা সাধারণ মানুষ জানাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল নিজেই তা মানুষদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন।

-------------
ব্যাখ্যা – ৪
-------------

“মাতৃগর্ভে কি আছে, তা আল্লাহ জানেন” – এ কথাটি বুঝতে হলে আমাদেরকে কোর’আনের আরো কিছু আয়াত দেখতে হবে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

اللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ كُلُّ أُنثَىٰ وَمَا تَغِيضُ الْأَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ ۖ وَكُلُّ شَيْءٍ عِندَهُ بِمِقْدَارٍ--- عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْكَبِيرُ الْمُتَعَالِ

“প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে, এবং জরায়ুতে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ তা জানেন। তাঁর নিকট প্রত্যেক বস্তুরই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। যা অদৃশ্য এবং যা দৃশ্যমান তিনি তা অবগত। তিনি মহান, সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।”[সূরা ১৩/ রা’দ – ৮,৯]

এ দুটি আয়াতের মাধ্যমে সূরা লোকমানের ৩৪ নং আয়াতকে আল্লাহ তায়ালা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। এ দুটি আয়াত অনুযায়ী আমরা বুঝতে পারি যে,

১। সন্তান মায়ের গর্ভে আসার পূর্বে যখন অদৃশ্য থাকে, তখন আল্লাহ তা জানেন। এবং মায়ের গর্ভে চলে আসার পর সন্তান যখন দৃশ্যমান হয়, তখনো আল্লাহ তা জানেন।

২। ইব্রাহীম (আ)-এর স্ত্রীর গর্ভে তাঁর সন্তান আসার পূর্বেই আল্লাহ তাকে সুসংবাদ দান করেছিলেন। অথবা, মরিয়ম (আ)-এর গর্ভে ঈসা (আ) আসার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা তাকে খবর দিয়েছিলেন। সুতরাং, যে কোনো মায়ের গর্ভে সন্তান আসার আগেই আল্লাহ তায়ালা সে সন্তান সম্পর্কে জানেন।

৩। “মাতৃগর্ভে কি আছে, তা আল্লাহ জানেন” – এর অর্থ হলো একটি সন্তান কখন, কোন মায়ের গর্ভে, কেমন রূপ ধারণ করবে, তা আল্লাহ জানেন। সন্তানটি কখন পৃথিবীতে আসবে, তাঁর ভাগ্য কেমন হবে, এবং কখন সে মারা যাবে, তাও আল্লাহ তায়ালা জানেন।

-------------
ব্যাখ্যা – ৫
-------------

“মাতৃগর্ভে কি আছে, তা আল্লাহ জানেন” – এ কথাটির অন্য একটি অর্থ হলো, মাতৃগর্ভে আল্লাহ তায়ালা নিজেই সন্তানের আকৃতি প্রদান করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

"তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" [সূরা ৩/ আলে ইমরান - ৬]

অর্থাৎ, সন্তান কালো হবে না সুন্দর হবে, নারী হবে না পুরুষ হবে, লম্বা হবে না খাটো হবে, সুস্থ হবে না অসুস্থ হবে, ভবিষ্যতে ভাগ্যবান হবে না দুর্ভাগ্যবান হবে, সব কিছু আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঠিক করে দেন। কোনো মানুষ ইচ্ছা করলে সন্তানের আকৃতি দান করতে পারবে না।
__________

উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট যে, সন্তান মেয়ে হবে না ছেলে হবে, এটা আল্লাহ তায়ালা নিজেই মানুষদেরকে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু, সন্তান মায়ের গর্ভে আসার আগে ও পরে সন্তানের আকৃতি, প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কেবল আল্লাহ তায়ালাই জানেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

What is The Ruling Regarding a Women Going to Hajj Without a Mahram?

Answered by Dr. Yusuf al-Qaradawi | Translated by Sister Marwa The original rule stipulated in shari’a that a woman is not to travel alone.  Rather, she has to be accompanied by her husband or any other mahram of hers.  This rule is supported by narrations of Bukhari and others that Ibn-Abbas (ra) said, that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel except with a mahram, and no man should visit her except in the presence of a mahram.” Abu-Hurairah related the following on behalf of the Prophet (pbuh), “It is not permissible for a woman who believes in Allah and the Last Day to travel for one day and night except with a mahram.” Abu-Sa’id reported that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel for two days except she is accompanied by her husband or a mahram.”