সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হতাশা থেকে মুক্তির উপায় - সূরা মা'আরিজ

হতাশা ও দুশ্চিন্তা নিয়ে কোর’আনের যে সূরায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, তার নাম সূরা মা’আরিজ। ৭০ নং সূরা।

সূরাটির শুরুতেই হতাশা ও দুশ্চিন্তার কারণগুলো বর্ণিত হয়েছে। হতাশার মূল কারণ হলো অধৈর্য।

অনন্ত সময়ের বিবেচনায় আমরা পৃথিবীতে কেবল দুই’এক সেকেন্ড অবস্থান করি। মাঝে মাঝে পৃথিবীর এই দুই’এক সেকেন্ড সময়কে অতিবাহিত করতে গিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। কিন্তু, আখিরাতের অনন্ত সুখের কাছে আমাদের পৃথিবীর এই কষ্ট ক্ষণিকের এবং খুবই সামান্য।

যেমন ধরুন, শিশু বাচ্চা জন্ম নেয়ার পর তাদের হাতে-পায়ে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের টিকা দিতে হয়। ইনজেকশনের সাহায্যে এই টিকাগুলো দেয়ার সময়ে শিশুরা অনেক কষ্ট পায়। তাদের আব্বু-আম্মুরাও দুঃখ পায়। কিন্তু, শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে, শিশুটি যাতে সুস্থ ও রোগমুক্ত থাকতে পারে সে কথা ভেবে, বাবা-মা তাদের আদরের শিশুটিকে কষ্ট দিয়ে থাকে। তেমনি পৃথিবীর কষ্ট হলো ক্ষণিকের। আখিরাতের অনন্ত সুখ পাবার জন্যে পৃথিবীতে সবাইকে কিছু না কিছু কষ্ট করতে হয়। আমাদের পার্থিব কষ্টগুলো হলো ভবিষ্যৎ বা অনন্ত জীবনে সুখী হবার টিকা।

বিষয়টি সহজে বুঝানোর জন্যে সূরা মা’আরিজে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ خُلِقَ هَلُوعًا

“নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে অস্থির-চিত্তরূপে” [সূরা ৭০/ মা’আরিজ - ১৯]

এই অস্থিরচিত্ত মনকে স্থির করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা বলেন –

تَعْرُجُ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ إِلَيْهِ فِى يَوْمٍۢ كَانَ مِقْدَارُهُۥ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍۢ . فَٱصْبِرْ صَبْرًۭا جَمِيلًا

“ফেরেশতাগণ এবং রূহ আল্লাহ তা’আলার দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর। সুতরাং, তুমি ধৈর্য ধারণ কর, পরম ধৈর্য।” [সূরা ৭০/মা’আরিজ – ৪, ৫ ]

পৃথিবীতে কষ্ট পেয়ে যেভাবে আমরা হতাশ হই, তা অনন্ত সুখী জীবনের তুলনায় শিশুকে টিকা দেয়ার মতোই। পৃথিবীর এসব কষ্টকে কেউ ধৈর্যের সাথে সহ্য করতে পারলে, তার জীবনে হতাশা বলে আর কিছু থাকে না।

এরপর, সূরাটি সামনের দিকে চলতে থাকে। মানুষ কেন হতাশ হয়, কাদের কারণে মানুষ হতাশ হয়, এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায় সূরা মা’আরিজ।

মানুষ সাধারণত ছয়টি জিনিস হারিয়ে ফেললে, অথবা হারিয়ে ফেলার ভয় থাকলে হতাশ হয়ে যায়।

১। প্রিয়তম-প্রিয়তমা, বা অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধবী [৭০/১০]
২। সন্তান-সন্ততি [৭০/১১]
৩। স্বামী-স্ত্রী [৭০/১২]
৪। ভাই, বোন, নিকট আত্মীয় [৭০/১৩]
৫। সুস্থতা [৭০/১৬]
৬। সম্পদ [৭০/১৮]

এই ছয়টি জিনিসের কোনো কিছু মানুষ যখন হারিয়ে ফেলে, বা হারিয়ে ফেলার ভয় করে, তখন সে চরম অধৈর্য হয়ে যায়। ফলে নানা ধরণের হতাশা ও দুশ্চিন্তা মানুষের অন্তরে চেপে বসে। শুধু তাই নয়, হতাশার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ হয়ে যায় তখন।

সূরাটির শেষ অংশে আল্লাহ তায়ালা মানুষদেরকে হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া উপায়গুলো শিখিয়ে দিলেন।

১। হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার প্রথম ও প্রধান উপায় হলো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। আর, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার অন্যতম উপায় হলো নামাজ পড়া। [৭০/২২] নামাজে সেজদায় গিয়ে আল্লাহর কাছে নিজের হতাশা ও দুঃখের কথাগুলো তুলে ধরতে পারলে, নামাজ শেষে মনের মাঝে এক অসাধারণ অনুভূতি জাগ্রত হয়।

আপনজন, সম্মান ও সম্পদ হারিয়ে যাবার ভয়ে আমরা হতাশ হই। কিন্তু নামাজে দাঁড়ালে মনে হয়, আল্লাহ আমাদের সবচেয়ে আপন, আর সম্মান ও সম্পদের মালিক তো কেবল আল্লাহ-ই। সুতরাং আমি কেনো হতাশ হব?

রাসূল (স) যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন, তখন বলতেন, “হে বেলাল, আযান দাও, নামাজ পড়ে আমি আমার মনকে প্রশান্ত করি।”

২। হতাশা ও দুশ্চিন্তা দূর করার দ্বিতীয় উপায় হলো, দুঃখীদের সাহায্য করা। যারা আপনার চেয়ে বেশি দুঃখী, এবং বেশি কষ্টে আছে, তাঁদেরকে আর্থিক সাহায্য করা। [৭০/২৪]

আমরা যখন নিজেদের চেয়ে আমাদের উপরের মানুষদের দেখি, তখন আমাদেরকে হতাশ হতে হয়। কিন্তু, আমরা যখন আমাদের চেয়েও নিচের এবং আমাদের চেয়েও কষ্টে জীবন-যাপন করা মানুষদের দেখি, তখন নিজেদের কষ্ট ও দুঃখ আর মনে থাকে না। নিজেকে তখন অনেক অনেক সুখী মনে হয়।

একজন দুঃখী মানুষের মুখে হাঁসি ফোটানোর চেয়ে বেশি আনন্দ পৃথিবীতে অন্য কিছুতে নেই।

৩। মানুষ নিজেকে যখন অন্যায় কোনো কাজের সাথে যুক্ত করে ফেলে, তখন নানা ধরণের হতাশা ও দুশ্চিন্তা তার মনের উপর জেঁকে বসে। এ কারণে, হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার তৃতীয় উপায় হলো, আল্লাহকে ভয় করা, এবং নিজেকে সর্ব অবস্থায় স্বচ্ছ রাখা। [৭০/২৭]

যারা সৎভাবে জীবনযাপন করেন, তাঁরা কখনো অন্যের দেয়া অপবাদ ও গীবত নিয়ে মাথা ঘামায় না। ফলে, হতাশা ও দুশ্চিন্তা তাদের আশেপাশেও আসতে পারে না।

৪। মানুষ সবচেয়ে বেশি হতাশায় ভোগে দাম্পত্য জীবন বা স্বামী-স্ত্রী-সংসারের কারণে। সহজ ভাষায় বললে, পরকীয়ার কারণে মানুষ অনেক দুশ্চিন্তায় ভোগে। সূরা মা’আরিজ অনুযায়ী, হতাশা ও দুশ্চিন্তা মুক্তির চতুর্থ উপায় হলো, নিজের প্রিয়তম/ সঙ্গী/ স্বামী, অথবা, প্রিয়তমা/ সঙ্গিনী/ স্ত্রী ব্যতীত অন্য কারো সাথে কোনো ধরণের সম্পর্কে না জড়ানো। [৭০/ ২৯]

“নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস” – এ কবিতার মতোই আমরা নিজেদের ঘরে সুখ না খুঁজে, অধৈর্য হয়ে, বাহিরে সুখ খুঁজতে যাই। কিন্তু, অধিকাংশ সময়ে, আগের চেয়েও বেশি হতাশা ও দুশ্চিন্তা নিয়ে আমরা ঘরে ফিরে আসি।

সুতরাং, ধৈর্য সহকারে নিজের পরিবার পরিজনের কাছেই সুখ খোঁজা উচিত।

৫। যখন আমরা মানুষকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারি না, তখন পার্থিব জীবনে নানা ধরণের ঝামেলা সৃষ্টি হয়। কিন্তু, মানুষকে ঠিক ততটুকুই প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত, যতটুকু প্রতিশ্রুতি পালন করার সমর্থ আমাদের আছে। হতাশার অন্যতম কারণ হলো মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া।

সূরা মা’আরিজ অনুযায়ী, হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার পঞ্চম উপায় হলো, মানুষের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। [৭০/৩২]

কোনো মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেয়ার আগে অথবা মানুষের আমানত নিজের কাছে হেফাজত রাখার আগে অসংখ্যবার ভাবা উচিত, এই প্রতিশ্রুতি ও আমানত কি আমি রক্ষা করতে পারব? – কেবল এই প্রশ্নটি অসংখ্য বিপদাপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। দিতে পারে হতাশা থেকে মুক্তি।

৬। হতাশা থেকে মুক্ত হবার ষষ্ঠ উপায় হলো, মিথ্যা সাক্ষী না দেওয়া এবং সত্যের উপর অটল থাকা। [৭০/৩০]

প্রতিদিন কতশত ঝগড়া-ফ্যাসাদের সাক্ষী হতে হয় আমাদের। প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে আমরা সত্য সাক্ষী দিতে পারি না। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায়, যার জন্যে আমি মিথ্যা কথা বললাম, তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। তখন হতাশা ও দুশ্চিন্তার পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে আমাদের মাথার উপর।

কেউ যতই আমাদের প্রিয় মানুষ হোক না কেনো, কারো জন্যে মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষী দেয়া মানে হতাশাকে ডেকে আনা। তাই, সর্বদা সত্যের উপর অটল থাকাই হতাশা থেকে মুক্তির উপায়।

৭। হতাশা, রাগ, ক্ষোভ ও দুশ্চিন্তার সপ্তম কারণ হলো অন্যের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া। এবং অন্যকে নিয়ে হাসি-তামাশা করা। [৭০/৪২]

বর্তমান সময়ে অন্যের সাথে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার একটি ভালো মাধ্যম হলো সোশ্যাল মিডিয়া। আগে দেখা যেতো, কোনো একটি বিষয়ে একজনের সাথে মাসে দু’একটি তর্ক-বিতর্ক হতো। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই ফেইসবুকে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকে। “যিনি সর্বশেষ কমেন্ট করবেন, তিনিই সেরা” – এই মানসিকতার কারণে আমাদের সকল ধৈর্য ও শেখার আগ্রহ হারিয়ে গিয়েছে। ফলে নানা ধরণের রাগ, ক্ষোভ, হিংসা ও হতাশা ২৪ ঘণ্টাই আমাদের ঘিরে রাখে।

নিজদের সত্য নিজেকে খুঁজে বের করতে হয়। অন্যের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে কেউ কখনো সত্য পায় না। তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে যে সত্য পাওয়া যায়, তা কেউই গ্রহণ করতে চায় না। সুতরাং হতাশা ও দুশ্চিন্তা মুক্ত সুখী জীবনের জন্যে সহজ উপায় হলো, যাবতীয় তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করা।
________
সূরা মা’আরিজ অসাধারণ একটি সূরা। হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে এ সূরায় আরও অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। হতাশ হলে আসুন, সূরা মা’আরিজটা অন্তত একবার পড়ি ফেলি।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

What is The Ruling Regarding a Women Going to Hajj Without a Mahram?

Answered by Dr. Yusuf al-Qaradawi | Translated by Sister Marwa The original rule stipulated in shari’a that a woman is not to travel alone.  Rather, she has to be accompanied by her husband or any other mahram of hers.  This rule is supported by narrations of Bukhari and others that Ibn-Abbas (ra) said, that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel except with a mahram, and no man should visit her except in the presence of a mahram.” Abu-Hurairah related the following on behalf of the Prophet (pbuh), “It is not permissible for a woman who believes in Allah and the Last Day to travel for one day and night except with a mahram.” Abu-Sa’id reported that the Prophet (pbuh) said, “A woman should not travel for two days except she is accompanied by her husband or a mahram.”