সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মিথ্যা কথা থেকে মুক্তির উপায়

মিথ্যুক শব্দটি শুনতে কার-ই বা ভালো লাগে? মিথ্যাবাদী পরিচয়টি আমারা কেউই ধারণ করতে চাই না। সবাই চাই, লোকে আমাদের সৎ ও সত্যবাদী বলুক। কিন্তু তারপরেও প্রতিদিন কারো না কারো সাথে, কিছু না কিছু মিথ্যা কথা আমাদেরকে বলতেই হয়।

সব সময় যে আমরা ইচ্ছা করেই মিথ্যা কথা বলি, ব্যাপারটা এমন না। কখনো আমরা ভুলে মিথ্যা বলি, কখনো অনিচ্ছা সত্ত্বে মিথ্যা বলি। কখনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মিথ্যা বলতে হয়, আবার কখনো পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে মিথ্যা বলতে হয়। এক কথায়, আমাদের জীবনের যাবতীয় ঝামেলা থেকে তাৎক্ষনিক ও সহজে মুক্তি পাবার জন্যে আমরা মিথ্যা কথা বলি।

মিথ্যা কথা বলাটা কেবল একটি পাপ নয়, এটি একটি আসক্তির মতো। পান, সিগারেট বা মদের মতই মিথ্যা কথা বলাটা একটি মারাত্মক বদ অভ্যাস। কেউ চাইলে খুব সহজেই মিথ্যা কথা বলা ছেড়ে দিতে পারে না। মিথ্যা কথা ছেড়ে দেয়ার জন্যে নিজের সাথে নিজের অনেক সংগ্রাম ও যুদ্ধ করতে হয়। অতীত জীবনে যিনি যতবেশি মিথ্যা কথার চর্চা করেন, তাঁর জন্যে মিথ্যা কথা ছেড়ে দেয়াটা ততবেশি কষ্টকর হয়ে থাকে।

মিথ্যা কথা ছেড়ে দিতে আমরা অনেকেই চাই, কিন্তু পারি না। কারণ, কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ছেড়ে দিতে চায়, তাহলে তাঁকে তিনটি বিষয় ভালোভাবে জানা প্রয়োজন।

১. আমরা কেনো এবং কখন মিথ্যা কথা বলি?
২. মিথ্যা কথা বললে নিজের কি ক্ষতি হয়?
৩. কিভাবে মিথ্যা কথা না বলে থাকা যায়?

সাধারণত অনেকগুলো কারণেই আমরা মিথ্যা কথা বলি। যেমন,

১। পারিবারিক বা সামাজিক কারণে ছোটবেলা থেকেই মনের অজান্তে মিথ্যা কথা বলার বদ অভ্যাসটি গড়ে উঠে।

২। অন্যের সাথে তুলনা করার পর যদি নিজেকে ছোট মনে হয়, তখন নিজেকে বড় হিসাবে উপস্থাপন করার জন্যে আমরা মিথ্যা বলি। অর্থাৎ, নিজের হীনমন্যতাকে ঢাকা দেয়ার জন্যে মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন হয়।

৩। প্রিয়জন বা আপনজনদের কাছে নিজেকে অনেক যোগ্য, দক্ষ, স্মার্ট, সৎ ও ভালো হিসাবে প্রকাশ করার জন্যে আমরা মিথ্যা বলি।

৪। যে কোনো ধরণের দায়িত্ব বা ঝামেলাকে সহজে এড়িয়ে যাবার জন্যে আমরা মিথ্যা বলি।

৫। কোনো পণ্য দ্রুত বিক্রি হবার জন্যে, বা, সহজে ধনী হবার জন্যে আমরা মিথ্যা বলি।

এছাড়া আরো অনেক কারণেই আমরা মিথ্যা বলি। কখন, কার সাথে, কেনো এবং কিভাবে মিথ্যা কথা বলেছি, তা স্মরণ করার চেষ্টা করলেই আমরা পেয়ে যাব, আমাদের মিথ্যা বলার কারণ কি?

কেউ যদি সত্যিই মিথ্যা কথা বলা ছাড়তে চায়, তাহলে প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, “কেন তিনি মিথ্যা কথা বলেন?”। কেউ যদি তাঁর মিথ্যা কথা বলার সঠিক কারণটি খুঁজে বের করতে পারেন, তাহলে মিথ্যা বলার আসক্তি বা বদ অভ্যাস থেকে অর্ধেক মুক্তি পাওয়া যায়।

এবার আসি, মিথ্যা বললে নিজের ক্ষতি কি? সে প্রসঙ্গে।

অনেকে মিথ্যা বলতে পারলে নিজেকে খুব চালাক মনে করেন। মিথ্যা বলে অন্যকে ঠকাতে পারলে এক ধরণের আনন্দ ও তৃপ্তি পান। অথচ, মিথ্যা বলে অন্যকে কখনো ঠকানো যায় না।

মিথ্যা কথা বলা মানে, নিজের সাথে নিজের বৈপরীত্য সৃষ্টি করা। যখন আমাদের মুখে এক কথা থাকে, আর মনে অন্য কথা থাকে, তখন মন ও শরীরের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। মিথ্যা কথা বলতে বলতে এক সময় এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, তখন মন দ্বারা আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অথবা, তখন আমাদের শরীর আমাদের মনের কথা শুনে না। ফলে, প্রাত্যহিক বিভিন্ন কাজে কর্মে মানুষের ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকে, এবং মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের উপর হতাশ হতে থাকে। এভাবে, হতাশা এক সময় মানুষকে অসহ্য যন্ত্রণা বা আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়।

এ কারণে রাসূল (স) বলেছিলেন –

“নিশ্চয় সত্যকথা মানুষকে ভালো কাজের দিকে পরিচালিত করে, আর ভালো কাজ মানুষকে প্রশান্তিময় বাগান বা জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। সত্য বলতে বলতে একজন মানুষ সত্যবাদী হিসাবে পরিচিত হয়। অন্যদিকে, মিথ্যা মানুষকে খারাপ কাজের দিকে পরিচালিত করে। আর, খারাপ কাজ মানুষকে আগুনের দিকে পরিচালিত করে। মিথ্যা বলতে বলতে একজন মানুষ আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী হিসাবে লিখিত হয়” [সহীহ বুখারী - ৬০৯৪]

একটি মিথ্যা কথা হলো একটি বক্সের মতো। আমরা যতবেশি মিথ্যা কথা বলি, ততবেশি নিজেদের বক্সে বন্দি করে ফেলি। অন্যদিকে, একটি সত্য কথা হলো একটি ঘরের দরজার চাবির মতো। আমরা যতবেশি সত্য কথা বলতে পারি, ততবেশি আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের বক্সগুলোকে আমরা ভেঙ্গে দিতে পারি।

মিথ্যা কথার ফলে মানুষ ভীরু ও কাপুরুষ হয়ে যায়। আর, সত্য কথার কারণে মানুষ সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হতে পারে। যিনি যতবেশি সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী, পৃথিবীতে তিনিই ততবেশি সফল হতে পারেন।

এবার আসি, মিথ্যা কথা থেকে আমরা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারি, সে প্রসঙ্গে।

সাধারণত আমরা সব মানুষের সাথে কিংবা সকল স্থানে মিথ্যা কথা বলি না। কিছু নির্দিষ্ট মানুষের সাথে, অথবা কিছু নির্দিষ্ট স্থানে, কিংবা কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতির স্বীকার হলেই কেবল আমরা মিথ্যা কথা বলে থাকি।

মিথ্যা কথা বলা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ঐ-সমস্ত মানুষকে চিহ্নিত করতে হবে, যাদের সাথে আমরা সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলি। ধরুন, আপনি আপনার অফিসের বস, অথবা স্ত্রী/বান্ধবীর সাথে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা বলেন। এ জীবনে তাঁদের সাথে যতগুলো মিথ্যা কথা বলেছেন, তা স্মরণ করুন। সবচেয়ে ছোট মিথ্যা কথা কোনটি ছিলো, তা খুঁজে বের করুন। এরপর তাঁদের কাছে সবচেয়ে ছোট মিথ্যা কথাটি স্বীকার করুন। এভাবে আস্তে আস্তে ছোট থেকে শুরু করে বড় বড় মিথ্যা কথাগুলো স্বীকার করতে থাকবেন। ফলে তাঁদের সাথে ভবিষ্যতে আর কখনো মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন হবে না।

তাছাড়া, কিছু কিছু মানুষ আমাদেরকে এমনভাবে প্রশ্ন করে যে, বাধ্য হয়েই মিথ্যা কথা বলতে হয়, সত্য বললে তারা মনে কষ্ট পান। এসব ক্ষেত্রে, প্রশ্নকারীকে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ থাকাই ভালো। অথবা, প্রশ্নকারী থেকে সময় নিয়ে পরবর্তীতে উত্তর দেয়া উচিত। অথবা, ভেবে চিন্তে এমন কথা বলা উচিত, যা মিথ্যাও হবে না, আবার প্রশ্নকারী মনেও কষ্ট পাবেন না।

দুষ্টুমি করে হোক, অথবা, কোনো ঝামেলা থেকে সহজে মুক্তি পাবার জন্যে হোক, মিথ্যা কথা বলাটা এক ধরণের ধ্বংসাত্মক আসক্তি বা বদ অভ্যাস। মিথ্যা কথা বলে মানুষ নিজেই নিজের ক্ষতি করে। সত্য কথা বলার অভ্যাস করতে হলে নিজেকে অনেক স্মার্ট হতে হয়। একজন মানুষ যতবেশি নিজের হীনমন্যতা দূর করতে পারেন, তিনি ততবেশি সত্য কথা বলতে পারেন। সত্য হলো সুখের মূলমন্ত্র, আর মিথ্যা হলো যন্ত্রণা ও হতাশার কারণ। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সুখী ও সত্যবাদী হবার তৌফিক দান করুক।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

মাথায় রুমাল দেয়া কি মাদানী হুজুর হবার লক্ষণ? নাকি ইহুদি হবার লক্ষণ?

এক তথাকথিত সালাফী মাদানী হুজুর নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে ভ্রান্ত মনে করেন। অথচ, নিজেই ইহুদিদের মতো মাথায় রুমাল দিয়ে ওয়াজ করেন। মাথায় রুমাল দেয়ার বিরুদ্ধে যেসব সহীহ হাদিস আছে, তা কি তিনি দেখননি? দলীল – ১ يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ দাজ্জালের বাহিনীতে ৭০ হাজার ইহুদী থাকবে, যাদের মাথায় চাদর বা রুমাল থাকবে। সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৯৪৪ দলীল – ২ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَعِيدٍ الخُزَاعِيُّ، حَدَّثَنَا زِيَادُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ، قَالَ: نَظَرَ أَنَسٌ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَرَأَى طَيَالِسَةً، فَقَالَ: «كَأَنَّهُمُ السَّاعَةَ يَهُودُ خَيْبَرَ» আনাস ইবনু মালিক (রা) জুমার দিনে মসজিদের মধ্যে সমবেত মানুষের দিকে তাকালেন। তিনি অনেকের মাথায় রুমাল দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এরা এখনো ঠিক খাইবারের ইহুদীদের মত। সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ৪২০৮ দলীল – ৩ قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : ” قال لقمان لابنه وهو يعظه : يا بني إياك والتقنع ، فإنها مخوفة بالليل مذلة بالنهار রাসূল (স) ...

আহলে কোর'আনের কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব - ২

মোহাম্মদ Junaid ভাইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর। ১) ইমামদেরকে standard মানতে হবে কেন? - ইমামদেরকে আমরা প্লেটো বা এরিস্টটলের মতো জ্ঞানী, স্কলার ও আলেম মনে করি, standard নয়। ২) ওনাদের status কী? - পৃথিবীর হাজার হাজার স্কলারের মাঝে ইমামরাও অন্তর্ভুক্ত। ৩) ওনাদের কি সুসংবদ্ধ চিন্তা ছিল? - জ্বী, উনাদের কাজ-ই ছিলো চিন্তাকে ফ্রেম দেওয়া। ৪) ওনাদের রচনাসমগ্ৰ কি সুলভ? - দুর্ভাগ্য আমাদের। বাংলা ভাষায় উনাদের বই পুস্তক অনুবাদ হয়নি। কিন্তু, উনাদের প্রচুর বই আছে, যা আমরা জানি না। ৫) প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত? - জী। ৬) বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তো প্রবহমান নদীর মতো। পুরা যুগের কারো পায়রবিতে আটকে থাকতে হবে কেন? - নদী যেমন তার উৎসের সাথে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না, তেমনি আমরাও আমাদের অতীতের সকল জ্ঞানের উৎসের সাথে বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না। বরং আমাদের জ্ঞানের উৎসে যাবার রাস্তা খোলা রাখতে চাই। ৭) জ্ঞানের পরিমাপক কী? - একজন মানুষ তার সময়ের কতগুলো সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছেন, সেটাই তার জ্ঞানের পরিমাপক। ৮) ওনারা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব গ্ৰহণ করবেন? - অবশ্যই না। তবে, পৃথিবীকে জানা...