সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিভিন্ন ধর্মের দশ আদেশ

ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো আল্লাহর ‘দশ আদেশ’ বা ‘Ten Commandments’। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এই দশটি আদেশ খুব বেশি পরিচিত না হলেও ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষেরা এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেন। তারা আল্লাহর এই দশটি আদেশকে কেবল ধর্মীয় আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ‘Ten Commandments’ নামে প্রচুর শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মীয় সিনেমা তৈরি করেছেন।


আল্লাহর এই দশটি আদেশ তাদের ধর্মীয় গ্রন্থসমূহের যেমন মূল শিক্ষা, কোরআনেরও তেমনি মূল শিক্ষা। কোরআনে সূরা আন’আমের ১৫১ থেকে ১৫৩ আয়াতে এই দশটি আদেশের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত বা পুরাতন বাইবেলের এক্সোডাস ২০ অধ্যায়ের ১-১৭ অনুচ্ছেদ ও ডিউটরনমি ৫ অধ্যায়ের ৬-২১ অনুচ্ছেদে; এবং খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিলে বা নতুন বাইবেলের মথি ১৯ অধ্যায়ের ১৬-১৯ অনুচ্ছেদ ও ২২ অধ্যায়ের ৩৪-৪০ অনুচ্ছেদে এই দশটি আদেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।


কেবল ধর্মগ্রন্থ নয়, বিজ্ঞানীরাও এই দশটি আদেশকে তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। যেমন বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন তার লেখায় উল্লেখ করেন যে, ‘মানুষকে সত্য বুঝতে হলে আল্লাহর এই দশটি আদেশকে মেনে চলতে হবে।’ [সূত্র: Keynes Ms. 7, King’s College, Cambridge, UK]


ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই দশটি আদেশ গুরুত্বপূর্ণ; কারণ তুর পর্বতে আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ)-কে দুটি পাথর খণ্ডে এই দশটি আদেশ খোদাই করে লিখে দিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ তাওরাতে যত আদেশ রয়েছে, সবগুলোর মূল হলো এই দশটি আদেশ। তাই ইহুদিদেরকে প্রতিটি ইবাদতে এবং উৎসবে বাধ্যতামূলকভাবে এই দশটি আদেশ পাঠ করতে হয়।


অন্যদিকে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নিকট এই দশটি আদেশ গুরুত্বপূর্ণ; কারণ ঈসা (আ) জৈতুন পর্বতে তাঁর সাহাবীদের সামনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেখানেও এই দশটি আদেশ ছিল। তাই খ্রিষ্টানদের জন্যও এই দশটি আদেশ মেনে চলা বাধ্যতামূলক।


এরপর মুসলিমদের জন্যে এই দশটি আদেশ গুরুত্বপূর্ণ; কারণ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষেরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার সময় বলে থাকেন, হে প্রভু ‘আমাদেরকে সরল পথপ্রদর্শন করুন।’ এর জবাব হিসেবে আল্লাহ তায়ালা সূরা আন’আমের ১৫১ থেকে ১৫৩ নং আয়াতে নিম্নোক্ত দশটি আদেশ উল্লেখ করে বলে দিলেন যে, ‘এই আদেশগুলো-ই হচ্ছে আমার পক্ষ থেকে সরল ও সঠিক পথ।’


পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা যত আসমানি কিতাব পাঠিয়েছেন, সবগুলোর নির্যাস রয়েছে তিনটি কিতাবে; যথা তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিলে। আর এই তিনটি কিতাবের মূল নির্যাস বর্ণনা করা হয়েছে আল কোরআনে। এর প্রমাণ হচ্ছে সূরা আন’আমের (১৫১ থেকে ১৫৩) এই তিনটি আয়াত। আল্লাহ তায়ালা এই তিনটি আয়াতের মাধ্যমে তাওরাত ও ইঞ্জিলের মূল শিক্ষা মুসলিমদের জানিয়ে দিতে চাইলেন। তাই তিনি ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স)-কে আদেশ দিয়ে বলেন।


“আপনি বলুন: এসো, আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শোনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন—


১) আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে অংশীদার করো না।


২) পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।


৩) দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমি তোমাদের যেমন রিজিক দেই, তাদেরকেও তেমন রিজিক দেই।


৪) প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক অশ্লীল কাজের নিকটেও যেয়ো না।


৫) যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে কাউকে হত্যা করো না, এ কাজকে আল্লাহ হারাম করেছেন। তিনি তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা অনুধাবন করো। [সূরা আন’আম, আয়াত ১৫১]


৬) এতিমদের ধনসম্পদের কাছেও যেয়ো না, যদি তাদের জন্য উত্তম কোনো ব্যবস্থা কর তাহলে ভিন্ন কথা।


৭) পরিমাণ ও ওজন ন্যায়-পূর্ণভাবে দেবে। আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেই না।


৮) যখন তোমরা কথা বলবে, তখন সুবিচার করবে, যদিও সে তোমার আত্মীয় হয়।


৯) আল্লাহর নামে তোমরা যে অঙ্গীকার কর, তা পূর্ণ করবে। তিনি তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। [সূরা আন’আম, আয়াত ১৫২]


১০) নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথের অনুসরণ করে চলো এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করো না। যদি বিভিন্ন পথ অনুসরণ কর তাহলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তোমাদেরকে তিনি এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সাবধান হও। [সূরা আন’আম, আয়াত ১৫৩]”


উপরে সূরা আন’আমের ১৫১নং আয়াতের পাঁচটি আদেশ হলো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আদেশ। ১৫২নং আয়াতের চারটি আদেশ হলো সামাজিক আদেশ। এবং ১৫৩নং আয়াতের শেষ একটি আদেশ হলো বৈশ্বিক আদেশ।


লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ১০টি আদেশের মধ্যে একটা চমৎকার ধারাবাহিকতা রয়েছে। প্রথম আল্লাহর অধিকার, দ্বিতীয় পিতামাতার অধিকার, তৃতীয় সন্তানের অধিকার, চতুর্থ স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, পঞ্চম সাধারণ ব্যক্তি মানুষের অধিকার, ষষ্ঠ এতিম ছেলে-মেয়েদের অধিকার, সপ্তম ব্যবসা-বাণিজ্যিক অধিকার, অষ্টম ও নবম সমাজের অধিকার, এবং দশম হলো বৈশ্বিক মানবতার অধিকার।


বিশ্বের সকল স্তরের সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যেই আল্লাহ তায়ালা এই দশটি আদেশ প্রতিটি ধর্মে বাধ্যতামূলকভাবে পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই দশ আদেশের এই তিনটি আয়াত আমাদের মুখস্থ করে নেওয়া এবং নিয়মিত মেনে চলা উচিত। আর তখনই কেবল পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

মাথায় রুমাল দেয়া কি মাদানী হুজুর হবার লক্ষণ? নাকি ইহুদি হবার লক্ষণ?

এক তথাকথিত সালাফী মাদানী হুজুর নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে ভ্রান্ত মনে করেন। অথচ, নিজেই ইহুদিদের মতো মাথায় রুমাল দিয়ে ওয়াজ করেন। মাথায় রুমাল দেয়ার বিরুদ্ধে যেসব সহীহ হাদিস আছে, তা কি তিনি দেখননি? দলীল – ১ يَتْبَعُ الدَّجَّالَ مِنْ يَهُودِ أَصْبَهَانَ، سَبْعُونَ أَلْفًا عَلَيْهِمُ الطَّيَالِسَةُ দাজ্জালের বাহিনীতে ৭০ হাজার ইহুদী থাকবে, যাদের মাথায় চাদর বা রুমাল থাকবে। সহীহ মুসলিম, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৯৪৪ দলীল – ২ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَعِيدٍ الخُزَاعِيُّ، حَدَّثَنَا زِيَادُ بْنُ الرَّبِيعِ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ، قَالَ: نَظَرَ أَنَسٌ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَرَأَى طَيَالِسَةً، فَقَالَ: «كَأَنَّهُمُ السَّاعَةَ يَهُودُ خَيْبَرَ» আনাস ইবনু মালিক (রা) জুমার দিনে মসজিদের মধ্যে সমবেত মানুষের দিকে তাকালেন। তিনি অনেকের মাথায় রুমাল দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, এরা এখনো ঠিক খাইবারের ইহুদীদের মত। সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ৪২০৮ দলীল – ৩ قال رسول الله – صلى الله عليه وسلم – : ” قال لقمان لابنه وهو يعظه : يا بني إياك والتقنع ، فإنها مخوفة بالليل مذلة بالنهار রাসূল (স) ...

আহলে কোর'আনের কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব - ২

মোহাম্মদ Junaid ভাইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার উত্তর। ১) ইমামদেরকে standard মানতে হবে কেন? - ইমামদেরকে আমরা প্লেটো বা এরিস্টটলের মতো জ্ঞানী, স্কলার ও আলেম মনে করি, standard নয়। ২) ওনাদের status কী? - পৃথিবীর হাজার হাজার স্কলারের মাঝে ইমামরাও অন্তর্ভুক্ত। ৩) ওনাদের কি সুসংবদ্ধ চিন্তা ছিল? - জ্বী, উনাদের কাজ-ই ছিলো চিন্তাকে ফ্রেম দেওয়া। ৪) ওনাদের রচনাসমগ্ৰ কি সুলভ? - দুর্ভাগ্য আমাদের। বাংলা ভাষায় উনাদের বই পুস্তক অনুবাদ হয়নি। কিন্তু, উনাদের প্রচুর বই আছে, যা আমরা জানি না। ৫) প্রামাণিকতা প্রশ্নাতীত? - জী। ৬) বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তো প্রবহমান নদীর মতো। পুরা যুগের কারো পায়রবিতে আটকে থাকতে হবে কেন? - নদী যেমন তার উৎসের সাথে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না, তেমনি আমরাও আমাদের অতীতের সকল জ্ঞানের উৎসের সাথে বাঁধ নির্মাণ করতে চায় না। বরং আমাদের জ্ঞানের উৎসে যাবার রাস্তা খোলা রাখতে চাই। ৭) জ্ঞানের পরিমাপক কী? - একজন মানুষ তার সময়ের কতগুলো সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছেন, সেটাই তার জ্ঞানের পরিমাপক। ৮) ওনারা কি কিয়ামত দিবসে আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব গ্ৰহণ করবেন? - অবশ্যই না। তবে, পৃথিবীকে জানা...