সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সব দলেই ভালো-খারাপ লোক থাকে

আওয়ামী লীগ খারাপ, বিএনপি ভালো। বিএনপি খারাপ, হেফাজতে ইসলাম ভালো। হেফাজতে ইসলাম খারাপ, আহলে হাদিস ভালো। আহলে হাদিস খারাপ, জামায়াতে ইসলামী ভালো। জামায়াতে ইসলামী খারাপ, আওয়ামী লীগ ভালো। ...এভাবে আমাদের বিতর্ক চলতে থাকে...।


কোনো দলের সবাইকে সম্মিলিতভাবে ভালো বলা যায় না, অথবা, কোনো দলের সবাইকে সম্মিলিতভাবে খারাপ বলা যায় না। কেউ কোনো একটি দলের অন্ধভক্ত হয়ে গেলে অনেকগুলো সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়।


যেমন, আহলে হাদিসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে কেন দরবেশ বাবা সালমান এফ রহমান থাকেন? আওয়ামী লীগের বাস ভবনে কেন হেফাজতের আমীর দাওয়াত খেতে যান? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের চেয়ে কেন মাহমুদুর রহমান বেশি ইসলামিস্ট? হেফাজতে ইসলামীর জন্যে কেন ফরহাদ মজহার প্রয়োজন? তাবলীগের ইজতিমায় কেন খালেদা ও হাসিনা মোনাজাত করতে যায়? আলেমদের মাহফিলে কেন শামীম ওসমান ওয়াজ করেন?


-এ ধরণের হাজারো প্রশ্ন তৈরি হয়, যখন আমরা সম্মিলিতভাবে কোনো দলকে ভালো বলি, অথবা, সম্মিলিতভাবে কোনো দলকে খারাপ বলি।


আগের একটি পোষ্টে (চিত্রসহ) আমি বোঝার চেষ্টা করেছি যে, আমরা মানুষকে যেভাবে ক্যাটাগরি করি, কোর’আন মানুষকে সেভাবে ক্যাটাগরি করে না। যে দলকে আমরা ভালো বলি, তাঁদের মাঝেও খারাপ লোক থাকে। আবার, যে দলকে আমরা খারাপ বলি, তাঁদের মাঝেও ভালো লোক থাকে।


এ পোষ্টে কোর’আন থেকে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।



কোর’আনের একটি সূরার নাম ‘সূরা মু’মিন’। এ সূরা নাম কেন ‘মু’মিন’ রাখা হল? কারণ, এখানে একজন মুমিন ব্যক্তির অলোচনা করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কে এই মুমিন ব্যক্তিটি?


এই মুমিন ব্যক্তিটি ছিল ফেরাউনের দলের একজন লোক। সে ফেরাউনের সাথেই কাজ করতো এবং ফেরাউনের সাথেই থাকতো; কিন্তু সে মনে মনে তাঁর ঈমানকে গোপন রাখতো।


ফেরাউন যখন মূসা (আ)-কে হত্যা করার প্রস্তুতি নিল, তখন ঐ মুমিন ব্যক্তিটি ফেরাউনকে নানাভাবে উপদেশ দিতে লাগলো।


وَقَالَ رَجُلٌۭ مُّؤْمِنٌۭ مِّنْ ءَالِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيمَـٰنَهُۥٓ أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَن يَقُولَ رَبِّىَ ٱللَّهُ وَقَدْ جَآءَكُم بِٱلْبَيِّنَـٰتِ مِن رَّبِّكُمْ ۖ وَإِن يَكُ كَـٰذِبًۭا فَعَلَيْهِ كَذِبُهُۥ ۖ وَإِن يَكُ صَادِقًۭا يُصِبْكُم بَعْضُ ٱلَّذِى يَعِدُكُمْ ۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى مَنْ هُوَ مُسْرِفٌۭ كَذَّابٌۭ


“ফেরাউন গোত্রের এক মুমিন ব্যক্তি তার ঈমান গোপন রাখত, সে বলল, তোমরা কি এমন একজনকে হত্যা করবে এজন্যে যে, সে বলে, “আমার পালনকর্তা আল্লাহ”; অথচ সে তোমাদের পালনকর্তার নিকট থেকে স্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের নিকট আগমন করেছে। যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে তার মিথ্যাবাদিতার জন্যে সে দায়ী থাকবে। আর যদি সে সত্যবাদী হয়, তবে সে যে শাস্তির কথা বলছে, তার কিছু না কিছু তোমাদের উপর পড়বেই। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারী, মিথ্যাবাদীকে পথ প্রদর্শন করেন না”। [সূরা ৪০/মু’মিন - ২৮]


এ আয়াতে স্পষ্ট যে, ফেরাউনের মত একটি খারাপ দলেও কিছু মু’মিন বা বিশ্বাসী মানুষেরা ছিল।



মূসা (আ)-এর নবুয়তের আগের ঘটনা। তিনি যখন তরুণ ছিলেন, তখন একদিন তিনি শহরে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর নিজের দলের একজন এবং তাঁর শত্রু দলের একজন মারপিট করছে। মূসা (আ) তাঁর দলের লোকটির পক্ষে অবস্থান নিয়ে শত্রু পক্ষের লোকটিকে ঘুষি মারলেন। এবং শত্রু পক্ষের লোকটি তাতে মারা গেল।


এরপর মূসা (আ) তাঁর নিজের অন্যায়ের অনুশোচনা করতে লাগলেন। এখানে অন্যায়টা কি ছিল?


মূসা (আ) নিজের দলের ব্যক্তিকে ভালো মনে করে তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু, আসলে তাঁর শত্রু পক্ষের লোকটি ছিল সঠিক।


وَدَخَلَ ٱلْمَدِينَةَ عَلَىٰ حِينِ غَفْلَةٍۢ مِّنْ أَهْلِهَا فَوَجَدَ فِيهَا رَجُلَيْنِ يَقْتَتِلَانِ هَـٰذَا مِن شِيعَتِهِۦ وَهَـٰذَا مِنْ عَدُوِّهِۦ ۖ فَٱسْتَغَـٰثَهُ ٱلَّذِى مِن شِيعَتِهِۦ عَلَى ٱلَّذِى مِنْ عَدُوِّهِۦ فَوَكَزَهُۥ مُوسَىٰ فَقَضَىٰ عَلَيْهِ ۖ قَالَ هَـٰذَا مِنْ عَمَلِ ٱلشَّيْطَـٰنِ ۖ إِنَّهُۥ عَدُوٌّۭ مُّضِلٌّۭ مُّبِينٌۭ


“মূসা যখন শহরে প্রবেশ করলেন, তখন তার অধিবাসীরা ছিল অসতর্ক। সেখানে তিনি দুই ব্যক্তিকে সংঘর্ষে লিপ্ত দেখলেন। একজন ছিল তাঁর নিজ দলের এবং অন্য জন তাঁর শত্রু দলের। অতঃপর, মূসার দলের লোকটি তাঁর শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে মূসার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং এতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বললেন, এটা শয়তানের কাজ। নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু, বিভ্রান্তকারী”। [সূরা ২৮/কাসাস - ১৫]


এরপর মূসা প্রতিজ্ঞা করলেন, নিজের দলের হলেও তিনি আর কখনো কোনো অপরাধীকে সাহায্য করবেন না, অথবা, অন্ধভাবে নিজ দলের পক্ষাবলম্বন করবেন না।



মূসা (আ)-এর নবুয়তের পরের ঘটনা। মূসা (আ)-এর দলকে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের আজাব থেকে রক্ষা করলেন। এবং ফেরাউনের দলকে সাগরে নিমজ্জিত করলেন।


মূসা (আ) ভাবলেন, তাঁর দলের সবাই ভালো। তিনি তাড়াতাড়ি তাঁদেরকে রেখে চলে গেলেন তুর পর্বতে। কিন্তু, আল্লাহ বললেন, তুমি এত তাড়াতাড়ি এখানে আসলে কেন? তুমি আসার পর তোমার সম্প্রদায়কে সামেরী পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে।


قَالَ فَإِنَّا قَدْ فَتَنَّا قَوْمَكَ مِنۢ بَعْدِكَ وَأَضَلَّهُمُ ٱلسَّامِرِىُّ


“আল্লাহ বললেন, আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি। তুমি চলে আসার পর সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে”। [সূরা ২০/তাহা - ৮৫]


এ আয়াতে স্পষ্ট যে, কোনো একটি ভালো দল যে কোনো মুহূর্তে সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে যেতে পারে।



রাসূল (স)-এর সাহাবীদের মত একটি শ্রেষ্ঠ দলেও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর মত মুনাফিকরা জায়গা করে নিয়েছিল। আবার, কাফিরদের নেতা আবু সুফিয়ানও শেষ পর্যন্ত মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন।


সুতরাং, যে কোনো দলে ভালো মানুষ যেমন আছে, খারাপ মানুষও তেমন আছে। কেউ ভালো দলে থাকার পরেও যে কোনো সময় পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার, কেউ খারাপ দলে থাকার পরেও যে কোনো সময় ভালো হয়ে যেতে পারে।
_______


“আমার দল একমাত্র বিশুদ্ধ দল। আমার দলের সবাই ভালো। অন্য দলের সবাই খারাপ।” – এমনটা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমরা আসলে কেউ জানি না, আমাদের মাঝে কে কখন ভালো থেকে খারাপ হয়ে যাবে, এবং কে কখন খারাপ থেকে ভালো হয়ে যাবে।


তাই, দলগতভাবে অন্ধ হয়ে বা দলগত পরিচয়ের কারণে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়া উচিত নয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

ওমরের ওয়াজে নারীর বাধা

মানুষের সামনে ওয়াজ করছেন ওমর (রা)। তিনি তখন অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা। বিশাল ক্ষমতাবান। কিন্তু, তাঁর বিরোধিতা করে এক বৃদ্ধ দুর্বল নারী দাঁড়িয়ে গেলেন। দুর্বল নারীটি ওমর (রা)-কে বললেন, "হে ওমর, আল্লাহকে ভয় করুন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ২০ নং আয়াতে নারীদের জন্যে দেনমোহর সীমিত করে দেননি, সেখানে আপনি দিচ্ছেন কেন?" ওমর (রা) বললেন, "নারীটি ঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।" [ইবনে হযর আল-আসকালানি,ফাতুল-বারী, ৯:১৬৭] ভাগ্য ভালো ঐ দুর্বল নারী সাহাবীটির। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর খলিফা ওমর (রা)-কে বাধা দিয়েছিলেন। যদি ঐ নারীটি এমন কোনো হুজুরকে বাধা দিতেন, যার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাহলে অবস্থাটা কি হতো দেখুন...

গণতন্ত্র সময়ের একটি চাহিদা

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনের কথা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? ধরুন, ১৬১৭ সাল। উসমানী খেলাফতের অধীনে তখন বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ ভূমি। সেই এক-তৃতীয়াংশ ভূমির খেলাফতের দায়িত্ব পালন করছেন সুলতান আহমদ। কেউ যদি তখন বলতো, আমরা সুলতান আহমদের পরিবর্তন চাই এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। তাহলে তখন কিভাবে সে নির্বাচনটি হত? তখন তো আর ইন্টারনেট বা টেলিভিশন ছিল না, এমনকি প্লেনও ছিল না। নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচনী তফসিলটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রত্যেকের কাছে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে করতে কমপক্ষে ৩ বছর সময় লেগে যেতো। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকল মানুষ যেহেতু খলীফা প্রার্থী হবার অধিকার রাখে, সুতরাং নির্বাচন কমিশনারের কাছে তাঁদের মনোনয়ন পত্র দাখিল করতে করতে সময় লাগতো আরো ২ বছর। নির্বাচন কমিশনার লক্ষ লক্ষ মনোনয়ন পত্র বাচাই করতে করতে লাগতো আরো ১ বছর। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের এবং আপিল নিষ্পত্তি করতে সময় লাগতো কমপক্ষে আরো ৫ বছর। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার সময় দিতে হতো কমপক্ষে আরো ১ বছর। কারণ প্রার্থীদেরকে বহুদূর থেকে এসে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হতো। তারপর, প্রা...