সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদম (আ) কি জান্নাতে ছিলেন?

- আদম (আ)-কে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর জন্যে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তাঁকে জান্নাতে রেখে দিলেন কেন?

- শয়তান কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না, কিন্তু আদম (আ)-এর জান্নাতে শয়তান কিভাবে প্রবেশ করল?

- জান্নাত থেকে আদম (আ) কিভাবে পৃথিবীতে চলে আসল?

- শয়তান যদি প্রতারণা না করত, তাহলে আদম (আ) কি কখনোই পৃথিবীতে আসতো না?

এ জাতীয় হাজারো প্রশ্নের সমাধান মিলবে, যদি আমরা নিচের একটি সহজ প্রশ্নের উত্তর জানতে পারি।

আদম (আ) কি দুনিয়ার জান্নাতে ছিলেন না আখিরাতের জান্নাতে ছিলেন?

কোর’আনে দুই ধরণের জান্নাতের বর্ণনা করা রয়েছে। একটি দুনিয়ার জান্নাত, অন্যটি আখিরাতের জান্নাত।

দুনিয়ার জান্নাতের সাথে আখিরাতের জান্নাতের পার্থক্য বুঝার জন্যে প্রথমে দুনিয়া ও আখিরাতের পার্থক্য জানা প্রয়োজন।

দুনিয়া শব্দের অর্থ নিকটবর্তী, এবং আখিরাত শব্দের অর্থ পরবর্তী। পৃথিবীতে যেসব গাছ-গাছালি, সুন্দর বন বা বাগান আমরা দেখতে পাই, তা হলো পৃথিবীর জান্নাত। আর, মৃত্যুর পরে ভালোমন্দ বিচার করার পর আমাদেরকে যে জান্নাত দেয়া হবে, তা হলো আখিরাতের জান্নাত।

এবার, কোর’আনের আলোকে দুনিয়ার জান্নাত ও আখিরাতের জান্নাতের কিছু পার্থক্য দেখুন।
________
১ম পার্থক্য।
________

দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইহুদি, খ্রিষ্টান, কাফের, মুশরিক যাকে ইচ্ছা তাকে বিশাল জান্নাত দান করেন। কিন্তু আখিরাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর খাস বান্দাদেরকেই কেবল জান্নাত দান করবেন।

وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلًا رَّجُلَيْنِ جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا

“আপনি তাদের কাছে দু ব্যক্তির উদাহরণ বর্ণনা করুন। আমি তাদের একজনকে আঙ্গুরের দুটি জান্নাত দান করেছি। এবং এ দু’টি জান্নাতকে খর্জূর বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছি। আর, দু’টি জান্নাতের মাঝখানে করেছি শস্যক্ষেত্র”। [১৮/কাহফ - ৩২]
________
২য় পার্থক্য।
________

দুনিয়ার জান্নাতে শয়তান প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু আখিরাতের জান্নাতে শয়তান কখনো প্রবেশ করতে পারে না। আদম (আ) যে জান্নাতে ছিলেন, সেখানে শয়তানও ছিল। শয়তান আদম (আ)-কে তাঁর জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল।

এ কারণে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, আমাদের পিতা-মাতার মত শয়তান যাতে আমাদেরকেও দুনিয়ার জান্নাত থেকে বের করে না দিতে পারে।

يَا بَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ الْجَنَّةِ

“হে আদম সন্তান! শয়তান যেভাবে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল, একইভাবে সে যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে”। [সূরা ৭/আরাফ – ২৭]

এ আয়াতে স্পষ্ট যে, শয়তান আদম (আ)-এর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারতো। আদম (আ) যদি আখিরাতের জান্নাতে থাকতেন, তাহলে শয়তান সেখানে প্রবেশ করতে পারতো না।
________
৩য় পার্থক্য।
________

দুনিয়ার জান্নাত খুবই ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আখিরাতের জান্নাত চিরস্থায়ী। দুনিয়ার জান্নাতে কেউ প্রবেশ করলে আবার বের হয়ে যেতে হয়। কিন্তু আখিরাতের জান্নাতে কেউ একবার প্রবেশ করলে আর কখনোই বের হতে হয় না। দুনিয়ার জান্নাত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন –

وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَن تَبِيدَ هَٰذِهِ أَبَدًا

“সে নিজের প্রতি জুলুমকারী হয়ে তার জান্নাতে প্রবেশ করল। এবং সে বলল, আমার এ জান্নাত কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না”। [সূরা ১৮/কাহফ – ৩৫]

এ আয়াতে পৃথিবীতে বসবাসকারী এক মুশরিক ব্যক্তির জান্নাতের কথা বলা হয়েছে। তার জান্নাতটি ছিল ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু সে তার জান্নাত বা বাগানটি নিয়ে সর্বদা গর্ব করত।

শয়তানের প্রতারণার কারণে, আল্লাহ তায়ালা আদম (আ)-কে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছেন। তাই এটি স্পষ্ট যে, আদম (আ) যে জান্নাতে ছিলেন, সেটাও ছিল একটি ক্ষণস্থায়ী জান্নাত বা দুনিয়ার জান্নাত।
________
৪র্থ পার্থক্য।
________

দুনিয়ার জান্নাতে থাকাকালীন সময়ে মানুষ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অর্জন করতে পারে, কিন্তু আখিরাতের জান্নাতে কেউ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অর্জন করতে পারে না।

وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا

“তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে জান্নাত তৈরি করবেন, এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন”। [ সূরা ৭১/নূহ – ১২]

এ আয়াতটি নূহ (আ)-এর উম্মতকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। তারা যদি আল্লাহর কথা মান্য করে, তাহলে দুনিয়াতেই আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে জান্নাত নির্মাণ করে দিবেন। তারা দুনিয়ার সে জান্নাতে বসবাস করে নিজেদের সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে নিতে পারবে।

আদম (আ) যে জান্নাতে ছিলেন, সেখানেও তাঁর সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে নেয়ার সম্ভাবনা ছিল। কারণ, আল্লাহ তায়ালা আদম (আ)-কে পৃথিবীর খলিফা হিসাবে মনোনীত করেছেন। ইবলিস যদি প্রতারণা না করতো, তাহলে পৃথিবীর যে জান্নাতে আদম (আ) ছিলেন, সেখানেই আমাদের জন্ম হত।
________
৫ম পার্থক্য।
________

দুনিয়ার জান্নাতে যা ইচ্ছা তা উপভোগ করা যায় না, এখানে মানুষকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হালাল ও হারাম মেনে চলতে হয়। কিন্তু আখিরাতের জান্নাতে সব কিছু হালাল, কোনো কিছুই হারাম নয়, সেখানে মানুষ যা ইচ্ছা তা উপভোগ করতে পারে।

وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ

“হে আদম তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। এখান থেকে যা ইচ্ছা খাও, কিন্তু এ বৃক্ষের কাছে যেয়ো না, তাহলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে”। [সূরা ৭/আরাফ – ১৯]

আদম (আ) যে জান্নাতে ছিলেন, সেখানে একটি গাছের নিকটবর্তী হওয়াকে আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন। কিন্তু জান্নাতে কোনো ফলকেই নিষিদ্ধ করা হয় না। [৫৬: ৩৩]। সুতরাং, আদম (আ) যে জান্নাতে ছিলেন, সেটি দুনিয়ার-ই কোনো জান্নাত ছিল।
________

দুনিয়ার জান্নাত হলো সেটাই, যেখানে আদম (আ) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে বসবাস করেছিলেন। আর, আখিরাতের জান্নাত সেটাই, যেখানে আদম (আ) তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে অবস্থান করবেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আল্লামা জালাল উদ্দিন রূমির বাণী ও কবিতা

ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ সারাবিশ্বের অমুসলিমরা যে মানুষটির লেখা সবচেয়ে বেশি পড়েন, তিনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। তাঁর ৫ টি বই ও একটি উপদেশ বাণী রয়েছে। ১। মসনবী, (৬ খণ্ড, ২৬০০০ কবিতার লাইন) ২। দিওয়ানে কবির, (৪০০০০ কবিতার লাইন) ৩। ফিহি মা ফিহি, (বিভিন্ন সভা ও মসলিসে দেয়া বক্তব্য) ৪। মাজালিশ-ই শব, (সাতটি বড় বক্তৃতা) ৫। মাকতুবাত, (১৪৭ টি চিঠি) আর একটি উপদেশ রয়েছে। উপদেশটি হলো – "অল্প খাও, স্বল্প ঘুমাও, কম কথা বল। গুনাহ থেকে দূরে থাক, সবসময় কাজ কর। সুখের অনুসন্ধানী মানুষদের থেকে দূরে থাক, এসব মানুষ তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। সৎ, ভালো ও সুভাষী মানুষের সাথে থাক। ভালো মানুষ তারা, যাদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। আর, ভালো কথা হলো তাই, যা সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রশংসা এক মাত্র আল্লাহর।" [১৭ ডিসেম্বর রূমির 'শবে আরুস'। শবে আরুস অর্থ দ্বিতীয় জন্মের রাত বা মৃত্যুর রাত]

সুফীদের জাহের ও বাতেনের সম্পর্ক

সুফিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ হলো জাহের ও বাতেন। জাহের মানে প্রকাশ্য, আর বাতেন মানে গোপন। সুফিদের মতে, প্রতিটি জিনিসের একটি অংশ থাকে প্রকাশ্য, এবং একটি অংশ থাকে অপ্রকাশ্য বা গোপন। যেমন, একটি গাছে প্রকাশ্য অংশ হলো গাছের কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল; আর গাছের অপ্রকাশ্য অংশ হলো শিকড়। সূফীদের কাজ বাতেন বা গাছের শিকড় নিয়ে কাজ করা, আর ফকিরদের কাজ গাছের পাতা-ফুল-ফল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা। গাছের মতো মানুষের প্রতিটি কাজেরও দুটি অংশ রয়েছে। জাহের ও বাতেন। যেমন, কেউ নামাজ পড়ার সময় রুকু-সিজদা করাটা হলো জাহেরি কাজ; আর নামাজে খুশু-খুজু বা মনোযোগ ধরে রাখাটা হলো বাতেনি কাজ। নামাজে রুকু সেজদা ঠিক হয়েছে কি হয়নি, তা শিক্ষা দেন ফকিহগণ; আর নামাজে কিভাবে মনোযোগ ধরে রাখা যায়, তা শিক্ষা দেন সুফিগণ। নামাজে কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই একজন মুফতি বলে দিবেন যে, নামাজ ঠিক হয়েছে। কিন্তু, একজন সুফি সূরা মাউনের ৪ ও ৫ নং আয়াত অনুযায়ী বলবেন যে, কেবল রুকু-সেজদা ঠিক মতো হলেই নামাজ হয়ে যায় না, নামাজে আল্লাহর প্রতি মনোযোগও থাকতে হবে। একইভাবে, ধরুন, আপনাকে আপনার প্রিয়া রাগ করে বললেন যে, "আমি আর তোমার কথা শুনতে চাই না...

তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?

এক ভাইয়া প্রশ্ন করেছেন – “তাকদীর বা ভাগ্য কি পূর্ব নির্ধারিত না পরিবর্তনশীল?” এ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও দার্শনিক দিক থেকে পৃথিবীতে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, এবং এখনো চলছে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে বলেছেন খুব সহজ ভাষায় লেখার জন্যে। অবশ্য, আমি সবকিছু সহজ-সরল করেই লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি ছোট মানুষ, কঠিন ও প্যাঁচালো লেখা যথাসম্ভব কম পড়ি ও লিখি। যাই হোক, তাকদীরের বিষয়টা আমার কাছে খুবই সহজ একটি বিষয় মনে হয়। এ বিষয়ে আমাদের মনে সাধারণত দু’টি প্রশ্ন জাগে। ১। ‘তাকদীর’ বা ভাগ্য যদি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে লাভ কি? অথবা, ২। আমরাই যদি নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর জবাব জানার আগে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করব।